১৯৪৬ সালে,
নোয়াখালিতে, মুসলমানদের
দ্বারা- হিন্দু হত্যার নির্মম ও নৃশংস ইতিহাস:
১০ অক্টোবর,
১৯৪৬। ঠিক এই দিনের সকালে নোয়াখালির হিন্দুদের উপর মুসলমানরা চাপিয়ে দেয় এক
ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। মুসলমান কর্তৃক রচিত এবং মুসলমান প্রভাবিত ইতিহাসে
এই ইতিহাসের কোনো স্থান নেই। কিন্তু এই ইতিহাসটা প্রত্যেক হিন্দুর জানা অবশ্য
কর্তব্য। তাহলে আমাদের পূর্ব পুরুষ হিন্দুদেরকে মুসলমান কর্তৃক যে নির্যাতনের
শিকার হতে হয়েছে, হয়তো সেগুলো
আমরা ভবিষ্যতে এড়াতে
পারবো এবং হিন্দু সমাজ, জাতি ও ধর্মকে
রক্ষা করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবো।
পরিকল্পনার কারণ :
পাকিস্তান আদায়ের জন্য মুসললমানরা ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট, কোলকাতায়, ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে বা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস পালন করে এবং প্রথম দুই দিনে প্রায় ১৫ হাজার হিন্দুকে হত্যা, অসংখ্য হিন্দুনারীকে ধর্ষণ, হিন্দুদের সম্পত্তি লুঠপাট এবং কিছু ধর্মান্তরের চেষ্টা চালায়। মুসলিম লীগ সরকার, হিন্দুদের কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে না বুঝতে পেরে হিন্দু বীর শ্রী গোপাল মুখার্জির নেতৃত্বে হিন্দু ও শিখ যুবকরা ঘুরে দাঁড়ায় এবং পাল্টা মুসলিম নিধন শুরু করে। এরপর সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগ সরকার দ্রুত পুলিশ-প্রশাসন নামিয়ে দাঙ্গা বন্ধ করে। বাংলার ক্ষমতায় মুসলিম লীগ সরকার থাকার পরেও প্রশাসনের কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই হিন্দুরা মুসলমানদের আক্রমনকে প্রতিরোধ ক’রে মুসলমানদের নিধন করার দুঃসাহস কিভাবে দেখাতে পারে ! এই অপমান মুসলমানদের সহ্য করা সম্ভব হয় নি। তাই এর পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করা হয় নোয়াখালি হিন্দু নিধন যজ্ঞের।
কিন্তু কেনো নোয়াখালি ?
নোয়াখালির ভৌগোলিক পরিবেশ এবং এর হিন্দু জনসংখ্যা, এর মূল কারণ। মুসলিমরা বুঝতে পেরেছিলো, কোলকাতায় হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি থাকার কারণে মুসলিম আক্রমন প্রতিরোধ করার সাহস তারা দেখিয়েছে এবং কিছু মুসলমানকে তারা হত্যা করতে পেরেছে। কিন্তু ১৯৪৬ সালে নোয়াখালির হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো ১৮.৬%, বাকিরা ঘাতক মুসলমান।এর ফলে মুসলমানরা বুঝে ছিলো, এখানে হিন্দুদের আক্রমন করলে তারা কিছুতেই আত্মরক্ষা করতে পারবে না। তাছাড়া নোয়াখালি নদী বেষ্টিত এলাকা। মুসলমানদের পরিকল্পনা ছিলো, হিন্দুদের এমনভাবে আক্রমন করা হবে, যাতে তারা পালাতে না পারে, এতে তারা হয় মুসলমান হয়ে জীবন বাঁচাবে, না হয় নিহত হবে। একারণে হিন্দু হত্যা শুরুর ঠিক আগে আগে নোয়াখালির টার্গেটেড এলাকায় যাতয়াতের সকল রাস্তা কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ইন-আউট পয়েন্টে মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের পাহারায় বসিয়ে দেওয়া হয়; যাতে একটা হিন্দুও পালাতে না পারে। আর নদী-নালাগুলোতে ছিলো মুসলিম মাঝিরা, তারাও নৌকা নিয়ে রাত-দিন পাহারা দিতো, যাতে কোনো হিন্দু জলপথেও পালাতে না পারে। এর ফলে জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ; এই অবস্থার মধ্যে পড়েছিলো নোয়াখালির হিন্দুরা। পরে মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়াদী (সুরাবর্দী) স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো, "আক্রান্ত এলাকার কিছু রাস্তা ধ্বংস করা হয়েছিলো এবং কিছু রাস্তা কেটে ফেলা হয়েছিলো।"
কে এই নিধন যজ্ঞের নায়ক এবং কেনো তার এই পরিকল্পনা ?
মুসলিম লীগের প্রাক্তন এম.এল.এ, সাহাপুর স্কুলের সেই সময়ের গভর্নিং বডির সভাপতি, গোলাম সারোয়ার তখন নোয়াখালির অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু দলে তার গুরুত্ব কিছুটা কমে গিয়েছিলো। সেই সময়, যে যত বড় হিন্দু বিদ্বেষী, সে তত বড় নেতা, এমন একটা ধারণা মুসলিম লীগে চালু ছিলো। তাই দলে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে এবং নিজেকে বড় মুসলমান প্রমাণ করতে ও কোলকাতায় পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে গোলাম সারোয়ার পরিকল্পনা করে এই হিন্দু নিধন যজ্ঞের এবং তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সাহায্য করে স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে মসজিদের মোল্লা-মৌলভীসহ সর্বস্তরের মুসলমান।
হিন্দু নিধনের প্রস্ততি পর্ব:
কোলকাতার দাঙ্গা ২০.৮.১৯৪৬ এ মোটামুটি শান্ত হয়ে আসে। এরপর ১০ দিন সময় নিয়ে মুসলমানরা তাদের পরিকল্পনা ঠিক করে এবং সেপ্টেম্বর মাস থেকেই নোয়াখালিতে লাগাতার হিন্দু বিদ্বেষী প্রচারণা শুরু করে। হিন্দুদের দোকান বয়কট করার জন্য আহ্বান জানানো হয় মুসলমানদের কাছে। বাজারে কোনো মুসলমান যাতে হিন্দুদের দোকান থেকে কোনো জিনিস না কেনে, সেজন্য মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের ভলান্টিয়াররা হিন্দুদের দোকানের সামনে পাহারা দিতো। শত প্রয়োজনেও কোনো হিন্দুর দোকান থেকে কোনো মুসলমান কোনো জিনিস কেনার চেষ্টা করলে তাকে মুসলিম লীগের গুণ্ডারা প্রকাশ্যে কান ধরে উঠ-বস করাতো। কোর্টে গিয়ে মুসলিম লীগের লোকজন মুসলমানদের কাছে আহ্বান জানায়, তারা যেনো কিছুতেই হিন্দু উকিলের কাছে না যায়। হাটের দিনে মুসলিম লীগের গুণ্ডারা হিন্দুদের পানের দোকানের সামনে পিকেটিং করতো, যাতে হিন্দুরা কিছুতেই পান বিক্রি করতে না পারে।
এভাবে সর্বস্তরে হিন্দুদের বয়কট করে মুসলমানরা প্রথমে হিন্দুদের ভাতে মারা চেষ্টা করে এবং তারপর শুরু হয় জান-মালের উপর আক্রমন। বেছে বেছে অবস্থাসম্পন্ন হিন্দুদের বাড়িতে ডাকাতি করা শুরু হয়। তারপর মানসিকভাবে চাপে রাখার জন্য প্রকাশ্য স্থানে, হিন্দুদের বাড়ির আশে-পাশে, মন্দিরের সামনে গরু জবাই করা শুরু হয়, এবং গরুর সেই মাংস ইচ্ছে করে হিন্দুদের বাড়ির উপর দিয়ে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গরুর রক্তে হিন্দুদের বাড়ির আশপাশ এবং মন্দিরগুলো অপবিত্র করা হয়। যেসব চাষাভূষা মুসলমান, হিন্দুদের বাড়িতে কাজ করতো, তারা হঠাৎ করে তাদেরকে তুই করে সম্বোধন করা শুরু করে এবং কোলকাতা থেকে কোনো আত্মীয়-স্বজন হিন্দুদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে, তাদের এভাবে জিজ্ঞেস করতো, 'কি রে, কোলকাতায় কটা মুসলমান মারলি ?' ইচ্ছে করেই 'তুই' শব্দটা ব্যবহার করে খুব সাধারণ মুসলমানও অবস্থাসম্পন্ন ও উচ্চ শিক্ষিত হিন্দুদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা শুরু করেছিলো।
এ অবস্থায় প্রশাসনের ভূমিকা :
ব্যবসা বানিজ্যে বয়কট এবং গ্রামে গ্রামে হিন্দু বাড়িতে
ডাকাতির ফলে, হিন্দুরা
পুলিশকে জানায় যে তাদের জীবন সংকটাপন্ন। ১০.৯.১৯৪৬ তারিখে নোয়াখালির জেলা শাসককে
লেখা একটি আবেদন পত্রে হিন্দুরা জানায়,
"আমরা এখানে
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। ‘কোলকাতা
দাঙ্গার বদলা চাই’ হুঙ্কার দিয়ে রোজ ই
এখানে মিছিল বের করা হচ্ছে। আমাদের দোকান থেকে জিনিসপত্র না কিনবার জন্য বলা
হচ্ছে।আমাদের জবাই করা হবে বলে শাসানো হচ্ছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য গ্রামে
সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হোক। আমরা গ্রামবাসীরা পুলিশ রাখবার খরচ বহন
করবো।"
এই দিনই পুলিশের কাছে আর একটি অভিযোগে বলা হয়, "গোলাম সারোয়ারের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের একটি মিছিল সাম্প্রদায়িক শ্লোগান দিয়ে গ্রাম পরিক্রমা করার সময় হিন্দুদের একটি মন্দিরকে অপবিত্র করে।"
বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ থানায় ১৩.০৯. ১৯৪৬ তারিখে একজন হিন্দু যে ডায়েরি করেন, তা এরকম,
"রেশন নিয়ে ফেরার পথে একদল লোক আমাকে আক্রমন করে। কিন্তু আমার গ্রামের লোক ঐ সময় চলে আসায় আমি বেঁচে যাই। কিন্তু যাবার আগে ওরা আমায় এই বলে শাসায় যে কোলকাতার বদলা ওরা নেবেই। আমরা কেউ নিস্তার পাবো না।"
১৮.০৯.১৯৪৬ তারিখে এরকমই আরেক ডায়েরিতে অভিযোগ করা হয়েছে, "আমাদের জীবন এখন সুতোর উপর ঝুলছে। আমাদের সবাইকে খুন করা হবে বলে শাসানো হচ্ছে। ওরা বলছে, শুধু হাইকমান্ডের নির্দেশ এখনো পাওয়া যায় নি, তাই আমাদের কতল করা হচ্ছে না।"
এভাবে এক দিকে যখন লাগাতার সন্ত্রাস করে হিন্দুদের মানসিকভাবে দুর্বল করা হচ্ছিলো, তখন অন্যদিকে ধর্মকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের উস্কানি দেওয়া হচ্ছিলো । গ্রামে গঞ্জে মোল্লা মৌলভীরা প্রচার করছিলো, "আর কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হচ্ছে, সমস্ত হিন্দুকে মুসলমান বানানো।"
হিন্দুদের এই হত্যার পরিকল্পনাকে এত ব্যাপকভাবে নেওয়া হয়েছিলো যে, যেহেতু হিন্দু-মুসলমান, গ্রামে পাশাপাশি বাস করে, সেহেতু চেনা জানার কারণে এবং দয়া পরবশ হেতু কোনো মুসলমান যদি কোনো হিন্দুকে হত্যা করতে পিছপা হয়, তাহলেও যেনো অপারেশন সাকসেসফুল হয়, সেজন্য বাইরে থেকে অবাঙ্গালি পাঠান এবং পেশোয়ারী মুসলমানদের এনে বিভিন্ন গ্রামে জড়ো করা হয়েছিলো। এ সম্পর্কে ২২ অক্টোবরের অমৃত বাজার পত্রিকা, পালিয়ে আসা ভূক্তভোগীদের একজন ফনীভূষণ শুর এর বয়ান উল্লেখ করে রিপোর্টে বলেছিলো, "আমাদের হাজিগঞ্জ গ্রামে আক্রমনের নেতৃত্ব দিয়েছে পেশোয়ারি মুসলমানরা। ওদের প্রত্যেকের হাতে ছিলো লম্বা তরোয়াল। ওদের নির্দেশেই খুন-লুঠ-ধর্ষণ-অপহরণ সংগঠিত হয়েছিলো। এছাড়াও বাইরের অনেক দুষ্কৃতিকে নোয়াখালিতে দেখা গেছে।"
শুধু তাই নয়, হিন্দু হত্যার এই পরিকল্পনাকে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য, এর পরিচালনার সমস্ত দায়িত্ব ভার অর্পন করা হয়েছিলো সেনা বাহিনীর অবসর প্রাপ্ত মুসলমানদের উপর। এভাবে সেনাবাহিনীর রণ-কৌশলের সমস্ত শিক্ষা নিরীহ অস্ত্রহহীন হিন্দুদের উপর প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। নোয়াখালি ঘুরে এসে ১৯ অক্টোবরের অমৃত বাজার পত্রিকায় এ সম্পর্কে এক সাংবাদিক লিখেছিলো, "দুষ্কৃতকারীদের মাথা ছিলো বিভিন্ন বাহিনীর সাবেক অফিসারগণ এবং তারা আক্রমনের ব্যবস্থা করেছিলো মিলিটারী মেজাজে। লোকজন তাদের নিকট থেকে শিখলো, কিভাবে রাস্তা খুঁড়তে হয় এবং কিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে হয়।"
কিন্তু সবকিছু জেনে বুঝেও মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশ -প্রশাসন হিন্দুদের রক্ষার কোনো ব্যবস্থা না করে চুপ করে বসে রইলো। এ সম্পর্কে ১৬.১০.৪৬ তারিখে “দ্য স্টেটসম্যান” পত্রিকায় লেখা হয়েছিলো, নোয়াখালির জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারিটেনডেন্ট ঐ বর্বরতা বন্ধ করতে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে নি।" এর কারণ নোয়াখালি জেলার পুলিশ প্রধান নিজে ছিলেন মুসলিম লীগের পরিকল্পিত এই দাঙ্গার প্রত্যক্ষ মদতদাতা। তার হিন্দু বিদ্বেষ এত প্রবল ছিলো যে এবং মুসলমান দাঙ্গাকারীদের সাথে সে এত বেশি ওতপ্রোতোভাবে জড়িত ছিলো যে, পুলিশের বিভাগীয় প্রধান তাকে ভর্ৎসনা করতে বাধ্য হয়েছিলো।
মে, ১৯৪৭ এর এক গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছিলো, "মুসলিম লীগ সরকারের সচিবালয় কোলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং থেকেও জেলা পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়, দাঙ্গার সাথে জড়িত হওয়ার অপরাধে যে সমস্ত লীগ সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়।" এই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়, "উদারপন্থী বলে পরিচিত এ.কে ফজলুল হকও দাঙ্গাকারীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য তদ্বির করেন।" ভিপি মেনন তার 'ট্রান্সফার অব পাওয়ার' গ্রন্থের ৩২২ পৃষ্ঠায় নোয়াখালির এই হিন্দু নিধন সম্পর্কে বলেছেন, "প্রশাসনের মৌন সম্মতিতে এটি ছিলো মুসলিম লীগের একটি সংঘবদ্ধ আক্রমন।" নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের দাদা শরৎচন্দ্র বোস, নোয়াখালি ঘুরে সাংবাদিকদের কিছু তথ্য দিয়েছিলেন, এটা ২৩ অক্টোবরের অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেছিলো, তিনি বলেছিলেন, "কোনো পুলিশ কোনো হিন্দুকে এবং তাদের পরিবারকে সাহায্য করে নি, যদিও আক্রমনের পূর্বেই বার বার পুলিশের কাছে তারা সাহায্য চেয়েছিলো।"
আক্রমন শুরু যেভাবে :
এভাবে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়ার পর, প্রশাসনের নীরব সম্মতিতে ১০ অক্টোবর, ১৯৪৬, বৃহস্পতিবার, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিনে শুরু হয় আক্রমন। ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্নাসী স্বামী ত্র্যাম্বাকানন্দ ঐ দিনের তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে,
"১০ অক্টোবর নোয়াখালির বেগমগঞ্জ বাজার এলাকায় মুসলিম লীগের একটি সভা চলছিলো। সভার প্রধান বক্তা ছিলো গোলাম সারোয়ার। সভায় ১৫ হাজার শ্রোতার সামনে সে তীব্র হিন্দু বিদ্বেষী বক্তব্য রাখে। সেখানে থানার দারোগা নিজে উপস্থিত ছিলো। কিন্তু তার সামনেই এসব চলতে থাকে। সভা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তেজিত জনতা বাজারের হিন্দু দোকানগুলি আক্রমন করে। লুঠ করবার পর সেগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর জনতা আলাদা আলাদা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তিন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।"
এরপর ভয়াবহ সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয় হিন্দুদের উপর। নোয়াখালি ও ত্রিপুরার, বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালি, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও কুমিল্লার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খুন, ধর্ষণ, লুঠ ও অপহরণ চলে বাধাহীনভাবে। অসহায়, আতঙ্কিত হিন্দুরা এদিক ওদিক পালাতে শুরু করে প্রাণের ভয়ে।
অমৃত বাজার পত্রিকা, ২২ অক্টোবর, ১৯৪৬ সালে, এই হিন্দু নিধন যজ্ঞের কিছু ঘটনা প্রকাশ করেছিলো, সেগুলো এরকম: "গোলাম সারোয়ারের জনসভা থেকে বের হওয়া তিনটি দলের একটি আক্রমন করে নারায়ণপুরের স্থানীয় জমিদার সুরেন্দ্রকুমার বোসের বাড়ি। তাঁকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।এর পর মুসলমানরা সুরেন্দ্রবাবুর কাছারি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে পালিয়ে আসা অনেক হিন্দু নর-নারী ও শিশু ঐ কাছারি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলো। তাদের অনেকেই জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যায়। যারা কোনো রকমে ঐ আগুন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলো, তাদেরও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। (এভাবে এখানেই একদিনে ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়।)
অপর একটি দল করপাড়া গ্রামে, নোয়াখালির ডিস্ট্রিক্ট বার এর সভাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ি আক্রমন করে। কিন্তু সেখানে স্থানীয় হিন্দুরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করলে মুসলমানরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। বাধা পেয়ে ওরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলিতে আক্রমন চালায়। হিন্দুদের মন্দিরগুলোর পবিত্রতা নষ্ট করে।। ইতিমধ্যে রাজেন্দ্রলাল বেগমগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ জানান এবং দ্রুত পুলিশি নিরাপত্তা দাবী করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রশাসনিক কোনো সাহায্যই তিনি পান নি।
পরদিন সকাল আটটায় এক বিরাট জনতা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ি আবার আক্রমন করে। কিন্তু রাজেন্দ্রবাবু গুলি চালিয়ে আক্রমনকারীদের হটিয়ে দেয়। এভাবে পর পর তিন বার মুসলমানরা পিছু হটতে বাধ্য হলেও চতুর্থবার তারা সফল হয়।মুসলিম লীগের প্রাক্তন এম.এল.এ গোলাম সারোয়ারের নির্দেশে আক্রমনকারী প্রথমেই রাজেন্দ্রলাল রায়কে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে, এরপর তার পরিবারের সবাইকে (দুই যুবতী মেয়ে বাদে) এবং শেষে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া হিন্দুদের হত্যা করে।
এরপরের ঘটনা, বিনয় ভূষণ ঘোষ, তাঁর 'দ্বি-জাতি তত্ত্ব ও বাঙালী' গ্রন্থের ৬৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, "রাজেন্দ্রলাল রায়ের কাটা মাথা একটি রূপার থালায় সাজিয়ে গোলাম সারোয়ারকে উপঢৌকন দেওয়া হয়। গোলাম সারোয়ারের নির্দেশে তার দুই প্রধান সেনাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়ের দুই সুন্দরী মেয়েকে পুরস্কার হিসেবে গ্রহন করে।"
রাজেন্দ্রলাল বা সুরেন্দ্রকুমার বোসকে এভাবে হত্যা করার কারণ সম্পর্কে রাজেন্দ্রলাল রায়ের ছোট ভাই অধ্যাপক এম.এল রায়, যিনি সেই সময় কোলকাতায় থাকার কারণে বেঁচে যান, তিনি ২২.১০.৪৬ তারিখে প্রকাশিত অমৃত বাজার পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "মুসলমানরা সমস্ত নোয়াখালিকেই ইসলামে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলো। তাই ওরা বেছে বেছে এমন লোকদেরকেই প্রথমে আক্রমন করেছিলো, যারা ওদের বাধা দিতে পারতেন। আমাদের পরিবারের সকলের মৃত্যুর এই একটিই কারণ।" অন্যভাবে বলা যায়, সমগ্র নোয়াখালি জেলাকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করতে প্রয়োজন ছিলো হিন্দু সমাজের শির দাঁড়াটা ভেঙ্গে দেওয়া। তাই মুসলমানরা প্রথমে তাদের উপরই আঘাত করেছিলো, যারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে হিন্দু সমাজের মধ্যে অগ্রগণ্য।
২৬.১০. ১৯৪৬ তারিখের স্টেটসম্যান পত্রিকায় আরেকটি ঘটনা ছাপা হয়। এই পত্রিকার এক সাংবাদিক, ভূক্তভোগী একটি বাচ্চা মেয়ের কাছ থেকে ঘটনাটি শুনে পত্রিকায় এই ঘটনাটি ছাপেন। সেই ঘটনাটি এরকম :
"১০ অক্টোবর সকালে গোলাম সারোয়ারের সভা থেকে বেরিয়ে আসা ৩ নং দলটি ঐ মেয়েটির বাড়িতে এসে মুসলিম লীগের তহবিলে ৫০০ টাকা চাঁদা চায়। চাঁদা না দিলে বাড়ির সবাইকে খুন করা হবে বলে হুমকি দেয়। প্রাণের ভয়ে মেয়েটির বাবা ওদের ৫০০ টাকা দিয়ে দেন। কিছুক্ষণ বাদে ওরা আবার আসে, সাথে এক বিরাট জনতা। ঐ বাড়ির একজন অভিভাবক, যিনি ছিলেন পেশায় মোক্তার, তিনি ঐ উত্তেজিত মুসলমানদের শান্ত করতে এগিয়ে যান। কিন্তু তিনি কোনো কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার আগেই তার মাথা কেটে ফেলা হয়। এরপর মুসলমানরা পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক লোক, যিনি মেয়েটির দাদু, তাকে খুন করে। এরপর মেয়েটির বাবার পালা। মেয়েটির বাবাকে তারই সদ্য খুন হওয়া পিতার মৃতদেহের উপর শুইয়ে দেওয়া হয়। তখন মেয়েটির ঠাকুমা, তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য ছেলের দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ওদের কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চাইতে থাকেন। কিন্তু তাতে মুসলমানরা ঐ বৃদ্ধা মহিলার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে এবং তার অচৈতন্য দেহকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরপর আবার মেয়েটির বাবাকে মারতে উদ্যোগী হয়। মেয়েটি ভয়ে এতক্ষণ ঘরের কোণে লুকিয়ে থেকে এসব দেখছিলো। বাবার প্রাণ বাঁচানোর জন্য সে তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং ঘাতক মুসলমানের হাতে ৪০০ টাকা ও কিছু গহনা দিয়ে কাকুতি মিনতি করে তার বাবাকে না মারার জন্য। এরপর ঐ ঘাতক মুসলমান, বাম হাতে ঐ টাকা-গয়না গ্রহন করে এবং ডান হাতে থাকা দা দিয়ে মেয়েটির বাবার মাথা কেটে ফেলে।"
নোয়াখালি হিন্দু নিধন যজ্ঞের আরও কিছু মর্মান্তিক ঘটনা:
ইসলামের জিহাদের সূত্র হলো, আক্রমনের প্রথমেই এমন কিছু লোককে হত্যা করতে হবে, যারা বাধা দেবার ক্ষমতা রাখে এবং তাদেরকে হত্যার ঘটনা এমন নৃশংস হতে হবে যাতে বাকি জীবিত হিন্দুরা ভয়াবহ মানসিক চাপে পড়ে এবং ভয়েই ইসলাম কবুল করে ফেলে। নোয়াখালিতেও ঘটনা হচ্ছিলো এই একই ঘটনা।
একটা ব্রাহ্মণ পরিবারের চার ভাই ছিলো। কুরবানির দিন ওদের মন্দিরে সামনেই গরু জবাই করা হলো এবং তারপর চারটি ঝুড়ি ভর্তি করে চার ভাইয়ের ঘরে গরুর মাংস পাঠিয়ে দেওয়া হলো। গরুর মাংস দেখে বাড়ির সবাই ঘৃণায় বমি করা শুরু করলো। ব্যস, আর যায় কোথায়। গ্রামের সমস্ত মুসলমান ওদের বাড়ি ঘিরে ধরলো। বললো, "শালা মালাউন, হারামাজাদা, আমাদের খোদার কাছে উৎসর্গ করা গোশতের অপমান করলি ! বিচার বসানো হলো, গরুর গোশতকে স্বীকার না করায় ওদের শাস্তি হলো, বাড়ির সব পুরুষকে নাকে খৎ দিতে হবে এবং জরিমানা দিতে হবে ২৫০ টাকা।
এছাড়াও নিচের এই পাশবিক ঘটনা গুলো 'রবীন্দ্রনাথ দত্ত' তার 'ধর্ষিতা মাতা, দ্বিখণ্ডিতা ভগিনী' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন; হিন্দুদের উদ্ধারের জন্য স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নোয়াখালি গেলে তিনি এগুলো নির্যাতিত হিন্দুদের কাছ থেকে শুনে লিপিবদ্ধ করেন।
ঘটনা (১) : এক জল্লাদ মুসলমান, এক হিন্দু মহিলার স্বামী সন্তানদের হত্যা করে, ঐ মহিলাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার বাড়ির একটা ঘরে তাকে তালা দিয়ে আটকে রেখেছে, যাতে সে পালাতে না পারে। ঐ মহিলা ঘরের মধ্যে বুক চাপড়াচ্ছে, মাথার চুল ছিঁড়ছে, ঘরের খুঁটির সাথে মাথা ঠুকছে, কখনো মুখ দিয়ে গেঁজা বের হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। কোনো মুসলমান পুরুষ মহিলা তাকে উদ্ধারের জন্য তো এগিয়ে আসেই নি, বরং তারা ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছিলো ঐ মহিলা কী করছিলো, এই দর্শকদের মধ্যে ঐ ঘাতক মুসলমানের স্ত্রী-সন্তানরাও ছিলো। মানুষ কী পরিমান নিষ্ঠুর হলে এরকম ঘটনা আরেক জন মানুষের উপর ঘটাতে পারে এবং তা অন্যরা মজা করে দেখতে পারে, এই ঘটনা তার একটি উদাহরণ।
ঘটনা (২) : পাড়ার সকল হিন্দু বাচ্চাদেরকে হিন্দুদেরই খড়ের গাদার উপর মই দিয়ে তুলে দিয়ে চারধারে কেরোসিন, পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো; তারপর বাচ্চারা, মা বাবা বলে চিৎকার করছিলো, এই শুনে উপস্থিত মুসলমানরা উল্লাস প্রকাশ করছিলো আর মজা দেখছিলো। কিছুক্ষণ পর আধা পোড়া বাচ্চাগুলো খড়ের গাদা থেকে গড়িয়ে পড়লে, ওদের পা ধরে নিকটবর্তী পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো ।
ঘটনা (৩) : যে সব হিন্দুরা মুসলমানদের তাড়া খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলো; তারা ডুব দিয়ে জেগে উঠলেই ওই সব হিন্দুদেরকে বর্শা, কোঁচ, টেটা দিয়ে আঘাত করে করে হত্যা করা হয়েছিলো। পরে ঐসব লোকের মৃতদেহ ভেসে উঠলে কাক-চিল-শকুন তাদের মাংস খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে মৃতদেহের সাথে গেঁথে থাকা বর্শা, টেঁটা ইত্যাদির কাঠের হাতলে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো আর ক্ষুধা পেলে মাঝে মাঝে মৃতদেহ ছিঁড়ে হিন্দুদের মাংস খাচ্ছিলো। নৃশংসতার পরিমান একবার চিন্তা করুন।
ঘটনা (৪) : বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে ঘটনা ঘটানো হয়েছিলো, তা হলো, বাড়ির সকল পুরুষদেরকে হত্যা করে বিবাহিত মহিলাদেরকে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে পা দিয়ে তাদের মাথার সিঁদুর মুছে ফেলে, হাতের শাখা ভেঙে ফেলে, ঐসব নরপশু মুসলমান, ঐ মহিলাদের এবং ঐ বাড়ির যুবতী মেয়েদের মুসলিম হতে বাধ্য করেছিলো এবং তাদেরকে বিয়ে করে নিয়েছিলো।
ঘটনা (৫) : এই ঘটনাটি ঢাকার। প্রত্যক্ষদর্শী রবীন্দ্রনাথ
দত্তের বাড়ির পাশের বাড়ির ঘটনা। ১০ অক্টোবর, ১৯৪৬; মুসলমানরা
হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে পাইকারি দরে আক্রমন করলে এক ব্যক্তি তার ১২/১৩ বছরের এক পুত্র
ও ছোট ২ কন্যাকে সাথে নিয়ে কোনো
রকমে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঐ ব্যক্তির স্ত্রীকে মুসলমানরা অপহরণ করে নিয়ে
গিয়েছিলো। পরিবাবের সম্মান রক্ষার্থে আশ্রয় দাতা পাড়ায় রটিয়ে দেয় যে, ঐ মহিলা মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছে।
তাই তার একটা শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করা হলো। হিন্দু বিধি অনুযায়ী ছেলেটার মস্তক
মুণ্ডন করা হবে। নাপিত, পুরোহিত বসে
আছে, শ্রাদ্ধের সব
আয়োজন সম্পন্ন। শ্রাদ্ধ উপলক্ষে প্রতিবেশিরা উপস্থিত হয়েছে। ছেলেটি বুঝতে পারলো যে, এটা তার মায়ের শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে, যেটা মানুষ মরলে করে; তাই আর সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে
কেঁদে উঠে ছেলেটি বলে ফেললো, "
আমার মা মরে নি, মুসলমানরা তাকে
ধরে নিয়ে গেছে।" বাড়ির তিন চার
জন যুবক ঐ ছেলেটির মুখ চেপে ধরলো, নাপিত মস্তক
মুণ্ডন করে দিলো। পুরোহিত মশায় দু চারটি মন্ত্র উচ্চারণ করে জীবিত মহিলার শ্রাদ্ধ
সম্পন্ন করলো।
গণহারে ইসলামে ধর্মান্তকরণ :
১৯ অক্টোবর, ১৯৪৬ তারিখে "আমরা সবাই ইসলামে দীক্ষিত হয়েছি" শিরোনামে একটি খবর কোলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আলোড়ন তুলেছিলো। নোয়াখালি থেকে বিভূতি ভূষণ দাস, কোলকাতায় তার ভাই সুধাংশুভূষণ দাসকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, এই চিঠির বিষয়বস্তু ই ছিলো এই শিরোনামের উৎস। এই খবরে যা ছাপা হয়েছিলো, তা একরম: "১০ অক্টোবর রাতেই আমাদের সকলকে ইসলামে দীক্ষিত করা হয়েছে। ঐ দিন রাতেই বিরাট সংখ্যক মুসলমান আমাদের গ্রাম আক্রমন করে। ওরা আমাদের, জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হবে বলে ভয় দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। ওরা আরও বলে যে, হাই কমান্ড নাকি সমগ্র নোয়াখালি জেলাকেই দার-উল-ইসলামে পরিণত করতে বলেছে। এইভাবে ওরা চাটখিল, রামপুর, দাসমেরিয়ার সমগ্র গ্রামবাসিকেও মুসলমান হতে বাধ্য করেছে।"
ধর্মান্তকরণের পরের ঘটনা :
ইসলামে দীক্ষা দেওয়ার পরই নব মুসলমানদের ইসলামিক নাম দেওয়া হতো। নামকরণের ব্যাপারে অবশ্য মুসলমানরা খুব সদয় ছিলো, ঠিক যেনো ধর্ষণের পর চিকিৎসা করানো। এতে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের তাদের পছন্দমতো নাম বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো। খালিশপাড়ার প্রিয়ময় চক্রবর্তী, নাম নিয়েছিলেন, 'মৌলভী হায়দার আলি চোধুরী ঠাকুর'। সদয় (!) মুসলমানরা- চৌধুরী, ঠাকুর ও মৌলভী প্রভূতি খেতাব বংশ মর্যাদা ও উচ্চ বর্ণের পরিচয় হিসেবে হিন্দুদের দিয়েছিলো।
নামকরণের পরই হিন্দুদের বাধ্য করা হতো গরুর গোশত খেতে এবং কলমা পড়তে। তেতুঁইয়া বাবুপুর গ্রামের দেবেন্দ্র কুমার নাথ বলেছেন, কানে আঙ্গুল দিয়ে মাথায় রুমাল বা গামছা দিয়ে কলমা পড়তাম এভাবে,
"কলমা তোয়ুব লাহে লাল্লা, ইল্লালাহ মহম্মদের রসুরইল্লা"
কিন্তু এত করেও খাঁটি মুসলমান হওয়া সম্পূর্ণ হতো না, যতক্ষণ না ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বাড়ির মেয়েদের মুসলমানরা বিয়ে করতো। নোয়াখালির বেগম গঞ্জ থেকে পালিয়ে আসা উত্তম বসু এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "আমাদের পাশের গ্রামের এক ভদ্রলোকের ছয় বছরের মেয়েকে কলমা পড়িয়ে এক মুসলমান ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। হিন্দুরা যে মুসলমান হয়ে গেছে এটা প্রমাণ করাই ছিলো এ ধরণের বিয়ের উদ্দেশ্য।" এখানে চিন্তা করুন, ছয় বছরের মেয়েকেও যদি মুসলমানরা না ছাড়ে, তাহলে হিন্দু ঘরের যুবতী মেয়েদের ওই নরপশুরা কী হাল করেছিলো ?
হাজিগঞ্জ থেকে উদ্ধার পাওয়া এক যুবকের কাছ থেকে জানা গেছে নিচের এই ঘটনাটি। শুনুন তার মুখেই: "ওরা বললো, আমাদের বাড়ির মেয়েদের ওদের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। আমার মামাতো বোন দেখতে খুব সুন্দরী ছিলো। দেখলাম অনেকেরই চোখ ওর দিকে। গ্রামের মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট, মামার কাছে ওকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলো। মামারও না বলার কোনো উপায় ছিলো না। যে বিয়ে করতে চায় তার বয়স তখন ষাট, আমার মামাতো বোনের পনেরো। আমরা সবাই মিলে অনেক পরামর্শ করার পর ঠিক হলো আমিই আমার মামাতো বোনকে বিয়ে করবো। সেই মতো মৌলভীকে জানালাম যে, ইসলাম ধর্মে তো মামাতো বোনকে বিয়ে করার বিধান আছে, এবং আমরা সবাই মুসলমান হয়ে গেছি। ভাগ্যগুনে উনি রাজি হয়ে গেলেন। সাত দিন আমরা স্বামী- স্ত্রীর অভিনয় করলাম। পরে মিলিটারি এসে আমাদের উদ্ধার করে।"
হিন্দু নিধনের সময় মুসলিম লীগ সরকারের ভূমিকা:
প্রথমেই মনে করিয়ে দিই এই সরকারের প্রধান মন্ত্রী ছিলো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পশ্চিমবঙ্গে যাকে বলে সুরাবর্দী; যে ডাইরেক্ট এ্যকশনের নামে ২০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করতে মুসলিমদের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা করে দিয়েছিলো। আগেই বলেছি, নোয়াখালিতে হিন্দু নিধনের জন্য প্রশাসনের সহায়তায় কিভাবে একটার পর একটা পরিকল্পনা সাজানো হয়। সেই সরকার, এই হিন্দু নিধনের খবর স্বীকার করবে বা প্রকাশ করবে, এমন ভাবাই তো অবাস্তব; হয়েছিলোও তাই।
নিধন শুরু হয়েছিলো ১০ অক্টোবর। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার তা প্রথম প্রকাশ করে ১৫ অক্টোবর, তাও খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে। সরকারের এই লাজুক স্বীকারোক্তিতে ১৫ তারিখেই দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা লিখলো, "বাংলা সরকার প্রাথমিক খবরে জানতে পেরেছে যে, নোয়াখালি জেলায় দাঙ্গা (প্রকৃতপক্ষে হিন্দু নিধন) শুরু হয়েছে। দাঙ্গাকারীরা ( মুসলমানরা) মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রাম আক্রমন করেছে। গত বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১০ অক্টোবর থেকে এই খুন ও লুঠ শুরু হয়। জোর করে ধর্মান্তরকণ (মুসলমান বানানো) এবং ধর্মীয় স্থান (মন্দির) অপবিত্র করার খবর এসে পৌঁছেছে। ব্যাপক হত্যা লীলা চলছে। জীবন্ত মানুষকেও পুড়িয়ে মারা হয়েছে। জেলার বার কাউন্সিলের সভাপতি (রাজেন্দ্রলাল রায়) ও তাঁর পরিবারের সবাইকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়েছে।"
কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার প্রকৃত সত্য প্রকাশ না করায়, অমৃত বাজার পত্রিকা ১৭ অক্টোবর, তাদের সম্পাদকীয়তে লিখলো, "নোয়াখালি থেকে রক্ত হিম করা খবর আমাদের দপ্তরে এসে পৌঁছেছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় বক্তব্য থেকেই এটা পরিষ্কার যে, এই দাঙ্গা (হিন্দু নিধন) ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। পরিকল্পনা অনুসারেই গত বৃহস্পতিবার থেকে খুন ও লুট শুরু হয়েছে। কিন্তু এটা ভাবতে অবাক লাগছে যে, এই ধরণের দাঙ্গার (হিন্দু নিধনের) খবর প্রথম প্রকাশিত হলো ১৫ই অক্টোবর। অর্থাৎ দাঙ্গা ( নিধন ) শুরুর ৫ দিন পর। দুঃখজনকভাবে অথবা বলা যেতে পারে রহস্যজনকভাবে, বাংলা সরকারের "ডিরেক্টর অব পাবলিসিটি" দ্বারা প্রকাশিত প্রেস নোট এতই সংক্ষিপ্ত ছিলো যে, এর থেকে কোনোভাবেই দাঙ্গার (হিন্দু নিধনের) ভয়াবহতা সম্পর্কে আঁচ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই দীর্ঘ ৫ দিন এভাবে সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রাখার কৈফিয়ত কে দেবে ? আর যাই হোক, নোয়াখালি নিশ্চয় পেশোয়ার বা কুইট্টা (অর্থাৎ বেশি দূর ) নয়। কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ। তবে কি রাজ্য সরকার, জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে এই ক দিন কোনো সংবাদ ই পায় নি ? এবং যদি পেয়ে থাকে তবে রাজ্য সরকার এই কয়দিন কী করেছে ?"
হিন্দু নিধন সম্পর্কে অন্যান্য বিশ্লেষণ :
শুধু খুন বা লুঠ নোয়াখালির হিন্দু নিধনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। এ ছিলো, ভবিষ্যৎ পাকিস্তান রাষ্ট্রের রূপরেখা কী হবে তার একটা ছোট্ট প্রদর্শন। জেলার সমস্ত হিন্দুকে মুসলমান বানিয়ে নোয়াখালিকে দার-উ-ইসলামে পরিণত করতে চেয়েছিলেন লীগের নেতৃবৃন্দ। তাই প্রয়োজন পড়েছিলো বলগাহীন সন্ত্রাসের। তৎকালীন বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য কংগ্রেস নেতা কামিনী কুমার দত্ত নোয়াখালির হিন্দু নিধনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন,
"এই দাঙ্গা-হাঙ্গামার পেছনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সমগ্র জেলাকে মুসলমানদের একচেটিয়া রাজত্বে পরিণত করা।"
নোয়াখালিকে দার-উল-ইসলামে পরিণত করার জন্য সেখানে একদিকে যেমন খুন-লুঠ-সন্ত্রাসের বলগাহীন রাজত্বে পরিণত করা হয়েছিলো, অন্যদিকে তেমনি ১২ থেকে ৪২ অসংখ্য হিন্দু নারীকে ধর্ষণ বা অপহরণের পর ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিলো। ভাগ্যবতী যে কজন নারী পালিয়ে আসতে পেরেছিলো, তাদের চোখেও ছিলো মৃত্যুর বিভীষিকা। "হয় কোরান, নয় মৃত্যু" নীতি অবলম্বন করে হিন্দুদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিলো। এমনকি তাদেরকে নিজ হাতে তাদেরই গরু জবাই করতে বাধ্য করা হয়েছিলো এবং সেই গরুর মাংস তাদের খেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আগেই বলা হয়েছে, হিন্দুদের সমস্ত পবিত্র স্থানগুলিকে অপবিত্র করা হয়েছিলো। এ সম্পর্কে ১৬ অক্টোবর, দ্য স্টেটসম্যান লিখেছিলো, "প্রায় ২০০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে, হিন্দুদের উপর, উত্তেজিত জনতা (মুসলমানরা) গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, হিন্দু মেয়েদের জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং হাজার হাজার হিন্দু মেয়েকে জোরপূর্বক মুসলমান বানানো হয়েছে। হাজার হাজার মুসলমান, হিন্দুদের গ্রাম আক্রমন করেছে এবং হিন্দুদেরকে বাধ্য করেছে তাদেরই গরু জবাই করতে এবং সেই গরুর মাংস খেতে এবং সব মন্দিরকে অপবিত্র করেছে।"
উদ্ধারকর্মীর বর্ণনায় হিন্দু নর-নারীদের অবস্থা :
নোয়াখালিতে আক্রান্ত পীড়িত মানুষদের সাহায্য করবার জন্য বেসরকারীভাবে বেশ কিছু রিলিফ কমিটি গঠন করে নোয়াখালিতে পাঠানো হয়েছিলো। মিস মুরিয়াল লিস্টার ছিলেন এরকম এক রিলিফ কমিটির সদস্য। ১৯৪৬ এর ৬ নভেম্বর, একটি রিলিফ সেন্টার থেকে তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠিটি ভি ভি নাগারকার এর "জেনেসিস" নামক গ্রন্থের ৪৪৬ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত আছে। চিঠিটির ভাষ্য এরকম : "দুর্দশায় সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা ছিলো নারীদের। এদের মধ্যে স্বচক্ষে অনেকেই আপন স্বামীকে নিহত হতে দেখেছে এবং তারপর বলপ্রয়োগে মুসলমান হওয়ার পর স্বামীর হত্যাকারীদের কোনো একজনকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। নারীদের চোখে ছিলো মৃতের চাহনি। সে চাহনি হতাশার অভিব্যক্তি নয়; কারণ, হতাশারও একটা ক্রিয়া আছে, এ যেন সম্পূর্ণ মসীলিপ্ত অন্ধকার। গোমাংস ভক্ষণ ও ইসলামের প্রতি আনুগত্যের শপথ বহু মানুষের উপরই জোর করে চাপানো হয়েছিলো এবং তা না করলে মৃত্যুই ছিলো দণ্ড।"
তদন্তকারীর বর্ণনায় নোয়াখালির হিন্দু নিধনযজ্ঞ :
মিস্টার সিম্পসন আই.সি.এস, নোয়াখালিতে হিন্দু নিধনের ভয়াবহ অবস্থা তদন্ত করতে গিয়েছিলেন। তিনি যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিনয় ভূষণ ঘোষের 'দ্বিজাতি তত্ত্ব ও বাঙালি' নামক গ্রন্থের ৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। তিনি বলেছেন, "প্রামান্য সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, একটি এলাকায় তিনশোরও বেশি এবং অপর একটি এলাকায় চারশোরও বেশি অসহায় নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।"
হিন্দু মেয়েদের উপর মুসলমানরা এ ধরণের অসম্মানজনক আক্রমন নামিয়ে এনেছিলো ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে। যেহেতু হিন্দুরা পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে নারীদের শ্রদ্ধা করে, তাই মুসলমানদের ধারণা ছিলো, হিন্দু নারীকে অপমান করতে পারলেই হিন্দু ধর্মকে আঘাত করা যাবে।
বৃহত্তর নোয়াখালি জেলা (বর্তমানের নোয়াখালি, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর) এবং কুমিল্লার কিছু অংশের গ্রামগুলিতে এমন হিন্দু পরিবারে সংখ্যা খুব কমই ছিলো, যে পরিবারের কোনো না কোনো মেয়ে অপহৃতা বা ধর্ষিতা হয় নি।
কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য জে.বি. কৃপালনী, নোয়াখালি ঘুরে যা দেখেছিলেন এবং শুনেছিলেন, তা তিনি ২২ অক্টেবরের অমৃত বাজার পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর বর্ণনা একরম :
"নোয়াখালি এবং ত্রিপুরার জনউন্মত্ততার কয়েকটি বিশেষ দিক উল্লেখ করা দরকার। ঐ উন্মত্ততার সব কিছুই ছিলো প্রশিক্ষিত নেতৃত্বের অধীনে ব্যাপকভাবে পরিকল্পিত। রাস্তাঘাট কেটে দেওয়া হয়েছিল। যত্র তত্র বন্দুকের ব্যবহার হয়েছিলো এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুণ্ডাদের বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। হাজার হাজার হিন্দুকে বলপ্রয়োগের দ্বারা ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। হাজার হাজার হিন্দু নারীকে অপহরণ করা হয়েছে অথবা জোরপূর্বক বিবাহ করা হয়েছে। তাদের পূজা স্থানকে অপবিত্র করা হয়েছে। এমনকি শিশুদের প্রতিও কোনো রকম করুনা দেখানো হয় নি। আর এই রকম পরিস্থিতিতেও স্থানীয় প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। প্রাদেশিক সরকারও ছিল নিষ্ক্রিয় এবং ভাইসরয় হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেছিলেন।" শুধু তাই নয়, ভাইসরয়, মুসলমানদের হাতে হিন্দু মেয়েদের এই অপহরণ ও ধর্ষণকে খুব স্বাভাবিক বলে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন,
"মুসলমান বাড়ির
মেয়েরা হিন্দু বাড়ির মেয়েদের মতো এত সুন্দরী নয়, তাই এই অপহরণ ও ধর্ষণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।”
এই তথ্যটি জে.বি.কৃপালনী নিজেই তার 'গান্ধী, হিজ লাইফ এন্ড থট' গ্রন্থের ২৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।
এই কংগ্রেস সভাপতির স্ত্রী, সুচেতা কৃপালনীও নারী উদ্ধারের কাজে নোয়াখালি গিয়েছিলেন। তার আগমনের খবর জানতে পেরেই হিন্দু নিধন যজ্ঞের খলনায়ক গোলাম সারোয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো, "সুচেতাকে যে ধর্ষণ করতে পারবে, তাকে বহু টাকা ইনাম দেওয়া হবে এবং তাকে গাজী হিসেবে ঘোষণা করা হবে।" তাই নিজের সম্মান রক্ষার জন্য সুচেতা সবসময় গলায় পটাসিয়াম সায়ানাইড ঝুলিয়ে রাখতেন। যেটা মুখে দিলে ১ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু ছিলো নিশ্চিত। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে এরকম সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারে, সেটা খুব সহজেই অনুমেয়।
ধর্মান্তরিত হিন্দুদের পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনেন শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রনাথ দত্ত :
ঘটানাটি রবীন বাবুর মুখেই তুলে ধরছি, "যখন তাদের
উদ্ধার করতে গেলাম তখন তারা বললো, 'বাবু, আমরা মুসলমান হয়ে গেছি। আমাদের মুখে
গোমাংস দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মহিলাদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হিন্দুরা কি আবার
আমদেরকে সমাজে নেবে ? আমাদের হাতে কি
জল খাবে ?' আমি বললাম, 'হিন্দুরা পূর্বের মতোই আপনাদেরকে
গ্রহন করবে, আমাদের
ধর্মগুরুরা বিধান দিয়েছে। তারা আমাদের মুখের কথাকে বিশ্বাস করলো না। ওই সময়
রামকৃষ্ণ মিশন থেকে 'পূর্ববঙ্গ ও
হিন্দু সমাজ' নামে একটা বই
প্রকাশ হয়েছিলো, তাতে আমাদের
ধর্মগুরুরা বিধান দিয়েছিলো, ধর্মান্তরিত
হিন্দুরা বিনা দ্বিধায় আবার হিন্দু সমাজে গৃহিত হবে। ছাপার অক্ষরের বই দেখে তারা
দলে দলে বাড়ি ঘর ছেড়ে আমাদের সাথে চলে এলো। তাতে মুসলমানরা বাধা দিলো না। কারণ, হিন্দুরা চলে গেলে তাদের স্থাবর
অস্থাবর সম্পত্তি মুসলমানদের দখলে আসবে।"
এভাবে হিন্দু পুরুষদের উদ্ধার করা হয়েছিলো, কিন্তু তাদের সব সম্পত্তি বেহাত হয়ে গিয়েছিলো। আর ধর্ষিতা ও অপহৃতা সব হিন্দু নারী যে উদ্ধার হয় নি, সেটা খুব সহজেই ধরে নেওয়া যায়। কারণ, যে মহিলারা পরিবারের সবাইকে হারিয়েছিলো এবং দিনের পর দিন ধর্ষিতা হওয়ার ফলে যারা গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলো, তারা হয়তো সেই জীবনকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলো। কারণ, তাদের তো আর কিছুই ছিলো না; না ধর্ম, না সম্মান, না স্বামী-সন্তান| তাই হয়তো তারা ভেবেছিলো, কি হবে আর ফিরে গিয়ে ? অথবা হয়তো এই সব হিন্দু মেয়েদের লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো, উদ্ধার কারীরা হয়তো তাদের খোঁজ ই পায় নি। পরে দিনের পর দিন কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেলে মিশে গেছে বোরকার কালো অন্ধকারে।
নোয়াখালির হিন্দু নিধন যজ্ঞ এবং নেহেরু ও গান্ধীর ভূমিকা :
আক্রমনের ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং রাজ্য সরকারের মুসলমানদের দুষ্কৃতিকারীদের সাহায্যদান; এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সক্রিয় ও ইতিবাচক ভূমিকা ছিলো খুবই জরুরী। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নোয়াখালির হিন্দুদের রক্ষার জন্য কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের দাবী জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর কাছে আবেদন জানান। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা ১৮ অক্টোবরের অমৃত বাজার পত্রিকায় ছাপা হয়। চিঠি এরকম : "যুদ্ধের সময় শত্রুর উপর ধ্বংস মূলক কার্যকলাপের কথা তবু বোঝা যায়। কিন্তু নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষের উপর এরকম সর্বাত্মক ধ্বংসলীলার কথা ভাবা যায় না। কেন্দ্রের কংগ্রেসী মন্ত্রীদের এই বলে বাংলার মন্ত্রীসভাকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত যে তারা বাংলায় একটা অত্যন্ত বিপজ্জনক খেলা খেলছে যা অন্যান্য রাজ্যের মানুষদেরকেও উত্তেজিত করে তুলবে।"
রাজ্যের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ কংগ্রেসের নীতি বিরোধী- এই যুক্তির মার প্যাঁচে শ্যামাপ্রসাদের আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়।
কেন্দ্র সরকারের এই উদাসীনতা ও অপদার্থতার সুযোগ নিয়েছিলো বাংলায় মুসলিম লীগের রাজ্য সরকার। হিন্দুদের রক্ষা করা তো দূরের কথা, আক্রমনের ১৩ দিন পরও প্রশাসন হিন্দুদের রক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয় নি। বনে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ানো অভূক্ত মানুষদের কাছে সামান্যতম ত্রাণ পাঠানোর প্রয়োজনও দুই সরকারের কেউ ই অনুভব করে নি। হিন্দুদের এই দূরাবস্থার কথা জানিয়ে ২৩ অক্টোবরের অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিলো, "আজ দাঙ্গার ( মুসলমান আক্রমনের) তের দিন অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও নোয়াখালি জেলার লক্ষ্মীপুর, রামগঞ্জ, রায়পুর, বেগমগঞ্জ, ও সেনবাগ থানার ১২০টি গ্রামের প্রায় ৯০ হাজার হিন্দু এবং ত্রিপুরা জেলার চাঁদপুর ও ফরিদগঞ্জ থানার প্রায় ৭০ হাজার হিন্দু দুর্বৃত্তদের ( মুসলমানদের) দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। ঐ অঞ্চলের মানুষের উপরে মৃত্যুর ছায়া দ্রুত নেমে আসছে। সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে এখনই ওখানে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো উচিত। কারণ, ঐ মানুষগুলির বেশির ভাগের কপালেই গত কয়েকদিন কোন খাবার জোটে নি।এখন এক মাত্র সৈন্যবাহিনীই পারে ওদের রক্ষা করতে।"
নোয়াখালির হিন্দুদের, মুসলমানদের এই বর্বরতা থেকে রক্ষা করার জন্য মাহাত্মা গান্ধীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছিলো। কিন্ত মাহাত্মা নোয়াখালি আসতে রাজী হলো না। কারণ, নোয়াখালি এসে তার কর্তব্য কর্ম কী হবে, সেই বিষয়ে ঈশ্বর নাকি তাকে কোনো নির্দেশ দেয় নি ! তাই মুসলমানদের আক্রমনে পীড়িত হিন্দুদের প্রতি সমবেদনা এবং দুঃখ জানিয়েই সে তার কর্তব্য শেষ করেছিলো। দিল্লিতে বসে গান্ধী যে বিবৃতি দিয়েছিলো; ১৭ অক্টোবর, অমৃতবাজার পত্রিকা তা ছাপিয়েছিলো। বিবৃতির বক্তব্য একরম : "নোয়াখালির সংবাদ আমি শুনেছি, শুনেছি কলকাতার রক্তস্নানের কথাও; কিন্তু আমি খুঁজছি, এই মূহুর্তে আমার কর্তব্য কর্ম কী ? নিশ্চয় ঈশ্বর আমাকে পথ দেখাবে।"
শুধু তাই নয়। হিন্দুদের উপর এই আক্রমনের জন্য মুসলিম লীগ বা আক্রমনে মদত দেওয়ার জন্য সুরাবর্দীর সাম্প্রদায়িক প্রশাসন সম্পর্কেও গান্ধী কোনো মন্তব্য করতে রাজী হয় নি। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে গান্ধী বলেছিলো, "২৩ অক্টোবর দিল্লিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির যে সভা বসবে তার আগে আমি মুখ খুলবো না।" ২০ অক্টোবর, দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা গান্ধীর এই বাণীটি ছাপিয়েছিলো।
কংগ্রেস এবং গান্ধীর এই হিজড়েপনার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছিলো মুসলিম লাগের নেতারা। তারা ২১ অক্টোবরেই এক প্রেস কনফারেন্স ডেকে বলে দিলো, "নোয়াখালিতে সম্পূর্ণ অরাজকতার কোনো চিহ্নই দেখা যায় নি। কিছু বাড়িঘরের ক্ষতি হয়েছে মাত্র।"
এরপরও গান্ধী এবং কংগ্রেস, নোয়াখালি নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য না করায়, মুসলিম লীগ আরও সাহস পেয়ে গেলো এবং ২৪ অক্টোবর ফের প্রেস কনফারেন্স ডেকে হিন্দুদের উপর মুসলমানদের আক্রমনের ঘটনাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বললো,
"নোয়াখালিতে এক সম্প্রদায়ের উপর আর এক সম্প্রদায়ের আক্রমনের কোনো ঘটনা ই ঘটে নি। কিছু সমাজ বিরোধী গণ্ডগোল বাঁধানোর চেষ্টা করেছিলো মাত্র। ধর্ষণ বা নারীদের উপর কোনো অত্যাচারের ঘটনা ই ঘটে নি।পত্রিকাগুলো এই নিয়ে মিথ্যা হৈ চৈ করছে।" ২৫ অক্টোবর, অমৃত বাজার পত্রিকা প্রেস কনফারেন্সের এই বক্তব্যটি প্রকাশ করেছিলো। একই দিন অমৃত বাজার, জিন্নার একটি বক্তব্যও প্রকাশ করেছিলো। জিন্না নোয়াখালির ঘটনা সম্পর্কে বলেছে, "নোয়াখালি সম্পর্কে খবরের কাগজগুলোতে যা লেখা হয়েছে, সেগুলি সবই আষাঢ়ে গল্প।"
বাংলার ইংরেজ গভর্নর অবশ্য মুসলমানদের সাথে সুর মেলালেন, কিন্তু মুসলমানদের মতো এতটা মিথ্যাবাদী হতে পারলেন না। তিনি বললেন, "নোয়াখালিতে দাঙ্গায় মৃতের সংখ্যা সামান্য এবং তা তিন অঙ্ক (অর্থাৎ ১০০) অতিক্রম করবে না।"
মুসলমানদের মিথ্যাচারের তো জবাব দেওয়ার মানেই হয় না। কিন্তু গভর্নর যেহেতু সত্যটা আঁচ করতে পেরেছিলো এবং ঘটনা কিছুটা স্বীকার করেছিলো, তাই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসু, গভর্ণরকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, "গভর্ণরের এই দাবীর ভিত্তি কী, আমি জানি না। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে, তা থেকে এটা পরিষ্কার যে, মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি এবং তা চার অঙ্কের ( অর্থাৎ ১০০০) এর কম নয়। এক মাত্র সুরেন্দ্র কুমার বোসের নারায়নপুরের বাড়িতেই এক দিনে একই সাথে চারশো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।"এই চ্যালেঞ্জটি ২৩ অক্টোবর, প্রকাশ করেছিলো অমৃত বাজার পত্রিকা।
নোয়াখালির হিন্দুদের জন্য গান্ধীর উপদেশ :
পাপাত্মা গান্ধী, নোয়াখালির হিন্দুদের, মুসলমানদের অত্যাচারের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার এক অসাধারণ অহিংস পথের সন্ধান দিয়েছিলো। এই নপুংসক, মুসলমানদের সশস্ত্র আক্রমনে ক্ষত বিক্ষত ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হিন্দুদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলো, "তারা (হিন্দুরা) যেন কখনোই অসহায়ভাবে মৃত্যু বরণ না করে। বরং তাদের উচিত একটিও শব্দ না করে হত্যাকারীদের তরবারির দিকে মাথা এগিয়ে দেওয়া, তাহলেই দাঙ্গা থেমে যাবে।"
দাঙ্গা তো অবশ্যই থামবে, যখন হত্যা করার জন্য কোনো হিন্দুই আর অবশিষ্ট থাকবে না, তখন মুসলমানরা আর কাকে মারার জন্য দাঙ্গা করবে ?
শুধু এখানেই শেষ নয়, এই পাপাত্মা, ধর্ষিতা বা অপহৃতা মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলেছিলো, তারা যেন তাদের অত্যাচারীদের বাধা না দেয়। কারণ, "মেয়েদের জানা উচিত কিভাবে মৃত্যু বরণ করতে হয়। সুতরাং খুব সাহসের সাথে মৃত্যুর মুখোমুখী দাঁড়াতে হবে এবং এর জন্য একটুও শোক করা উচিত নয়; কেবল মাত্র তাহলেই তাদের উপর এই অত্যাচার (ধর্ষণ ও অপহরণ) বন্ধ হবে।" আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে গান্ধীর প্রকৃত জন্ম দাতা কে ? সে কোনো মানুষ ? না অন্য কোনো জানোয়ার ? গান্ধীকে এখন আমার হিজড়া বলে গালি দিতেও খারাপ লাগে। কারণ, এতে প্রকৃতির খেয়ালে যারা হিজড়া হয়ে জন্ম নিয়েছেন, আমার মনে হয়, তাদেরকে অপমান করা হয়।
গান্ধী পোকার এই সব দুর্গন্ধ, ১৮ অক্টোবর দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকা প্রকাশ করেছিলো।
গান্ধীর এসব বাজে কথাবার্তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য কৃপালনী। তিনি আরো বলেছিলেন, "গত কয়েক দিন ধরে আমি যা দেখেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার কিছু করুক বা না করুক; স্ত্রী, পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক হিন্দুর আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করা উচিত।" কৃপালনী আরও বললেন, "আমি যদিও সম্পূর্ণ অহিংসায় বিশ্বাসী, তা সত্ত্বেও রাজেন্দ্রলাল রায়ের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। প্রত্যেক বাঙালির সামনে আমি রাজেন্দ্রলাল রায় এবং তার পরিবারের কথা উদাহরণ স্বরূপ তুলে ধরতে চাই, যারা দুদিন ধরে লড়াই করে আক্রমনকারী উন্মত্ত জনতাকে (মুসলমানদের) ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।" কৃপালনীর এই সব বক্তব্য প্রকাশ করেছিলো অমৃত বাজার পত্রিকা ২২ অক্টোবর তারিখে।
২৪ অক্টোবর, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে এক বিরাট জনতা দিল্লিতে গান্ধীর হরিজন কলোনীর প্রার্থনা সভায় উপস্থিত হয়। তারা গান্ধীকে নোয়াখালির হিন্দু মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক সুরাবর্দীর মন্ত্রীসভাকে বাতিল করার ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু গান্ধী পুনরায় তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে নোয়াখালির সমস্ত হিন্দুকে মুসলমানদের তরবারির নিকট আত্মসমর্পন করার পরামর্শ দেয়; কেননা, তার মতে, মুসলমান আক্রমনকারীদের বাধা দেওয়ার মানেই হলো অযথা রক্তপাত। সেই সময় গান্ধী আবারও উপস্থিত লোকজনকে স্মরণ করিয়ে দিলো তার সেই বিখ্যাত দুর্গন্ধময় আবর্জনা, "নিহত হও, কিন্তু কাউকে হত্যা করো না।" গান্ধীর এসব মল মূত্র ভারত বাসীর জন্য প্রকাশ করলো অমৃত বাজার পত্রিকা ২৫.১০. ১৯৪৬ তারিখে।
নোয়াখালির হিন্দু নিধনে ভারতের অন্যান্য স্থানে প্রতিক্রিয়া:
নোয়াখালিতে হিন্দুদের উপর মুসলমানদের সশস্ত্র আক্রমন, হত্যা, ধর্ষণ, লুঠপাট, বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, জোর পূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও দেব স্থান অপবিত্র করার প্রতিবাদে এবং নিহত হিন্দুদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বাংলা থেকে বহুদুরে বোম্বেতে ব্যবসায়ীরা সমস্ত দোকান-বাজার বন্ধ রেখেছিলো; বেনারসে ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করেছিলো; পাটনা ও দিল্লিতে ধর্মঘট পালিত হয়েছিলো। দিল্লি, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং সিন্ধুতে, হিন্দু ও শিখরা দিপাবলী উৎসবে আলো জ্বালানোর চিরাচরিত প্রথা বর্জন করে ব্ল্যাক ডিওয়ালী পালন করেছিলো। কিন্তু, যে বাঙ্গালি হিন্দুদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে মোটামুটি সারা ভারত কিছু না কিছু করলো, সেই বাঙ্গালি হিন্দুরা কোলকাতায় এর তো কোনো প্রতিবাদ করলোই না, উল্টো, নোয়াখালিতে মুসলমানদের আক্রমন শুরু হওয়ার মাত্র ১৪ দিনের মাথায়- এবং তখনও কোথাও কোথাও হিন্দুদের উপর নির্যাতন চলছে, এমন অবস্থায়- অনুষ্ঠিত হওয়া কালী পূজা খুব ধূমধামের সাথে পালন করলো। যেনো কোথাও কিছু হয় নি! একটা জাতি কি পরিমান নির্বোধ হলে এমন মানসিকতার শিকার হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। সংখ্যায় বেশি হওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা যে এখনও পদে পদে মুসলমমানদের হাতে মার খাচেছ, এর মূল কারণ কিন্তু এটাই। মার খাওয়া এবং তার প্রতিবাদে কিছু না করা এদের রক্তে মিশে গেছে।
হিন্দুদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে কলকাতার হিন্দুরা সে বছর যে শুধু ধূমধাম করে কালীপূজাই করলো, তা নয়; অনবরত প্রত্রিকায় নোয়াখালির হিন্দুদের উপর হত্যা ও নির্যাতনের খবর প্রকাশ ও জানতে পারা সত্ত্বেও বাংলার কোথায় সাধারণ মানুষের মাঝে একদিনের জন্যও এতটুকু প্রতিবাদের খবর পাওয়া যায় নি। এ সম্ভবত হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু সাধু সন্ন্যাসীদের নিরামিষ ভোজন এবং তাদের উপদেশে কাম-ক্রোধ ত্যাগ করার কুফল।
নোয়াখালির হিন্দু নিধন সম্পর্কে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পূর্ণাঙ্গ বিবৃতি :
(এই বিবৃতিটি ড.
দীনেশ চন্দ্র সিংহের 'নোয়াখালির মাটি
ও মানুষ' গ্রন্থে
মুদ্রিত আছে।)
ড. মুখার্জি নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার উপদ্রুত অঞ্চল সফর করে এসে এক বিবৃতিতে বলেন, "নোয়াখালি ও ত্রিপুরা জেলার উপদ্রুত অঞ্চলের ঘটনাবলীর মধ্যে এমন একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যাহা ভারত বর্ষের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। অবশ্য ইহাকে কোনো ক্রমেই সাম্পদ্রায়িক দাঙ্গা বলা চলে না। ইহা সংখ্যালঘিষ্ট সম্প্রদায়ের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সংঘবদ্ধ ও সুপরিকল্পিত আক্রমন। এই আক্রমনের প্রধান লক্ষ্য ছিলো ব্যাপকভাবে ধর্মান্তকরণ ও লুণ্ঠন, গৃহদাহ ও সমস্ত বিগ্রহ ও দেবমন্দির অপবিত্রকরণ। কোনো শ্রেণির লোককেই রেহাই দেওয়া হয় নাই। অপেক্ষাকৃত ধনীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা আরও কঠোর হয়। হত্যাকাণ্ডও পরিকল্পনার অঙ্গ ছিলো; কিন্তু যাহারা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং যাহারা প্রতিরোধ করেন, প্রধানত তাহাদের জন্যই এই ব্যবস্থা ছিল। নারী হরণ, ধর্ষণ এবং বলপূর্বক বিবাহ এই সকল কুকার্যের অঙ্গ ছিল। কিন্তু এই প্রকার নারীর সংখ্যা কত, তাহা স্থির করা সম্ভব নহে। যে সকল ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিল এবং যে সকল কার্যপদ্ধতি অবলম্বিত হইয়াছিল তাহাতে দেখা যায় যে, এই সমস্তই সমূলে হিন্দু লোপ ও পকিস্তান প্রতিষ্ঠার একটি পরিকল্পনার অন্তর্গত ছিল। মুসলিম লীগের জন্য এবং ধর্মান্তকরণ অনুষ্ঠানের ব্যয়, ইত্যাদি নানা কারণে চাঁদা চাওয়া হইয়াছিল। ইহা দেখা যায় যে, আক্রমনকারীগণ ও দলপতিরা মুসলিম লীগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিল। তাহা ছাড়া তাহারা আরও জানিত যে, প্রদেশে তাহাদের নিজেদের গভর্নমেন্ট রহিয়াছে এবং তাহাদের স্ব-সম্প্রদায়ভূক্ত স্থানীয় রাজ কর্মচারীরাও সাধারণতঃ তাহাদের প্রতিই সহানূভুতিসম্পন্ন। এই প্রকার ধারণার বশবর্তী হইয়া কুকার্যে তাহাদের সাহস আরও বাড়িয়া যায়।
এই সকল কুকীর্তির নায়ক এক দল গুন্ডা ছিল অথবা তাহাদের অধিকাংশই বাহির হইতে আসিয়াছিল- এরূপ বলিলে মিথ্যা বলা হইবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকেরা এসব পৈশাচিক কাণ্ড করে এবং সাধারণভাবে এই সকল কার্যের প্রতি লোকের সহানুভূতি ছিল। কয়েক ক্ষেত্রে মুসলমানরা লোকের প্রাণ বাঁচাতে সাহায্য করিয়াছে; কিন্তু তাহাদের সংখ্যা অতি নগন্য। এভাবে যাহাদের জীবন রক্ষা পায়, তাহারা পলায়নে অসমর্থ হইলে তাহাদিগকে ধর্মান্তরিত হইয়া গ্রামে থাকিতে হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে এবং তাহাদের ধনসম্পত্তিও লুণ্ঠন হইতে রক্ষা পায় নাই। ভাবী বিপদের আশংকা পূর্বাহ্নেই কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা হইয়াছিল। কিন্তু যাহারা দিনের পর দিন হিংসা ও বিদ্বেষ প্রচার করিতেছিল, সেই সব প্রকাশ্য প্রচারকদের কার্যকলাপ বন্ধ করিতে তাহারা চেষ্টা করেন নাই। যখন সত্যসত্যই হাঙ্গামা বাধিয়া উঠিল এবং কয়েকদিন যাবৎ চলিতে লাগিল, কর্তৃপক্ষ তখন লোকের ধন প্রাণ রক্ষা করিতে অপারগ হইলেন। এই অক্ষমতা দ্বারা তাহারা নিজেরাই নিজেদের নিকট ধিকৃত হইয়াছেন এবং স্ব স্ব পদে বহাল থাকা সম্বন্ধে অযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাহারা যতক্ষণ উপস্থিত থাকিবেন, ততক্ষণ স্বাভাবকি অবস্থা ফিরাইয়া আনা সহজ হইবে না। এই প্রকার একটা অঘটন ঘটিয়া যাইবার পরও নোয়াখালিতে মাত্র ৫০জনকে এবং ত্রিপুরায় জনকতককে গ্রেফতার করা হইয়াছে।
সহস্র সহস্র লোক বিপজ্জনক এলাকার অন্তঃস্থল হইতে পালাইয়া গিয়া অত্যাচারীর নাগালের ঠিক বাহিরে জেলার ভিতরেই আশ্রয় গ্রহন করিয়াছে। তাহাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। যে সকল স্থান এখনও উপদ্রুত হয় নাই, সেই সকল স্থান হইতেও অধিবাসীরা হাজারে হাজারে পালাইয়া আসিয়া আশ্রয় কেন্দ্রগুলিতে আশ্রয় লইয়াছে। কুমিল্লা, চাঁদপুর আগরতলা ইত্যাদি স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হইয়াছে। সর্ব শ্রেণীর স্ত্রী পুরুষ শিশু সহ এই সকল আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতার সংখ্যা ৫০ হাজার হইতে ৭৮ হাজার হইবে।
এই সকল লোক ছাড়াও আরও প্রায় ৫০ হাজার বা ততোধিক লোক এখনও বিপজ্জনক এলাকায় রহিয়াছে।এই এলাকাকে বেওয়ারিশ এলাকা বলা যাইতে পারে। এই এলাকার অবরুদ্ধ ব্যক্তিগনকে একদিনও বিলম্ব না করিয়া উদ্ধার করিতে হইবে। তাহাদের সকলকেই ধর্মান্তরিত করা হইয়াছে এবং তাহারা এখনও অত্যাচারীর হাতের মুঠোর ভিতরে। তাহারা এখন নামে মাত্র মানুষ। তাহাদের আধ্যাত্মিক মৃত্যু ঘটিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশই সর্বস্বান্ত| এবং তাহাদের শরীর মন দুই ই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। তাহাদের মধ্যে তপসিলি বা অন্যান্য শ্রেণী নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণীর হিন্দু আছে। তাহাদের উপর যে অপমান ও নির্যাতন চলিয়াছে, তাহার সীমা নাই। তাহাদের নাম পরিবর্তন করা হইয়াছে, তাহাদের স্ত্রীলোকেরা অপমানিত হইতেছে, তাহাদের ধন সাম্রাজ্য লুন্ঠিত হইয়াছে; তাহাদের মুসলমানের মতো পোষাক পরিতে, আহার করিতে ও জীবন যাপন করিতে বাধ্য করা হইতেছে। পরিবাবের পুরুষ দিগকে মসজিদে যাইতে হয়। মৌলবী বাড়িতে আসিয়া তাহাদিগকে শিক্ষা দেয়। আহার্যের জন্য-এমনকি অস্তিত্ব পর্যন্ত টিকিয়া রাখিবার জন্য তাহাদিগকে অবরোধকারীদের দয়ার উপর নির্ভর করিয়া থাকিতে হয়। তাহারা যাহাতে তাহাদের সমাজ হইতে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইতে পারে, সেজন্য তাহাদিগকে দুরত পরিবর্তনের ভেতর দিয়া লইয়া যাওয়া হইতেছে। তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া গেলেই তাহাদের আত্মসমর্পন সম্পূর্ণ হইবে।
তাহারা প্রতিবাদ করিতে সাহসী হয় না; এমনকি বাহির হইতে যেসব হিন্দু তাহাদের গৃহে আসে, তাহাদের সহিত তাহারা দেখা পর্যন্ত করিতে সাহস করে না। পূর্বে যাহারা নেতৃস্থানীয় হিন্দু ছিল, তাহাদের পুরাতন ও নতুন উভয়বিধ নাম ব্যবহার করিয়া প্রচার পত্র বিলি করা হইতেছে যে, তাহারা স্বেচ্ছায় নতুন ধর্ম গ্রহন করিয়াছে এবং সকলকে ভবিষ্যতেও বর্তমানের মত অবস্থায় থাকিতে অনুরোধ করিতেছে; তাহারা স্বেচ্ছায় ধর্মান্তর গ্রহন করিয়াছে বলিয়া মহকুমা হাকিমদের নিকট আবেদন পত্র পাঠানো হইতেছে। বাহিরে যাইতে হইলে তাহারা স্থানীয় মুসলিম নেতাদের স্বাক্ষরিত ছাড়পত্র লইয়া বাইরে যাইতে পারে। আমরা যখন নোয়াখালির নিকট চৌমুহনীতে ছিলাম, তখন তাহাদের কয়েকজন তথায় উপস্থিত হইতে সমর্থ হয়। দুইজন মুসলিম লীগ মন্ত্রী ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের সহিত তথায় আলোচনা করিতেছিলেন। আগন্তুকরা তাহাদের সম্মুখেই নিজেদের মর্মবিদারী কাহিনী বর্ণনা করে।
এখন সর্বাপেক্ষা জরুরী সমস্যা হইতেছে, যে বহুসংখ্যক লোক এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের হাতের মুষ্টির ভেতরে রহিয়াছে, তাহাদিগকে উদ্ধার করা। গ্রামগুলি পাহারা দিয়া রাখায় এবং রাস্তাঘাট বন্ধ করিয়া রাখায় এতদিন কাহারো পক্ষে উপদ্রুত এলাকায় প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ছিল। এখন মিলিটারি উপদ্রুত এলাকায় যাতায়াত করিতে থাকায় ঐ এলাকায় যাতায়াত ক্রমশঃ সহজ হইয়া আসিয়াছে।কিন্তু কেবল যাতায়াত করিলেই চলিবে না; ঐ সঙ্গে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দিগকে প্রত্যেকটি গ্রামে প্রবেশ করিয়া অবরুদ্ধ এলাকার সহস্র সহস্র হৃতবল হিন্দুদের মনে বিশ্বাস ও নিরাপত্তার ভাব ফিরাইয়া আনায় সাহায্য করিতে হইবে।
... ...
পুনর্বসতির প্রশ্নও অবিলম্বে বিবেচনা করিতে হইবে। শীঘ্রই ফসল কাটিবার সময় আসিবে। যাহারা অন্যত্র আশ্রয় লইয়াছে, তাহারা তাহাদের ভাগের ফসল না পাইলে তাহাদিগকে অনশনে থাকিতে হইবে। নিরাপত্তার মনোভাব ফিরিয়া না আসিলে পুনর্বসতি সম্ভব হইবে না। যাহাদের ঘর-বাড়ি ও সম্পত্তি বিনষ্ট হইয়াছে, তাহাদিগকে ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে। ঘর-বাড়ি প্রস্তত না হওয়া পর্যন্ত তাহাদিগকে গ্রামের নিকট বিশেষভাবে নির্মিত আশ্রয় শিবিরে স্থান দিতে হইবে। গ্রামে নিজেদের ঘর-বাড়ি ও মন্দির পুননির্মিত না হওয়া পর্যন্ত হিন্দুদের ভয় দূর হইবে না।
আমাদের সহস্র সহস্র ভ্রাতা ভগিনী এইভাবে নতি স্বীকারে বাধ্য হইয়া হিন্দু সমাজের গণ্ডীর বাহিরে চলিয়া গিয়োছেন বলিয়া আমরা মনে করতে পারি না। তাহারা হিন্দু ছিলেন, তাহারা এখনও হিন্দু এবং তাহারা আমরণ হিন্দু থাকিবেন। এই নির্দেশের বহুল প্রচার করিতে হইবে। প্রায়শ্চিত্তের কথা উঠিতেই পারিবে না।
যখন কোন মহিলাকে উপদ্রুত এলাকা থেকে উদ্ধার করা হইবে, বলপূর্বক তাহাকে বিবাহ করা হইলেও তিনি বিনা বাধায় স্বীয় পরিবারে ফিরিয়া যাইবেন। যে সকল কুমারীকে উদ্ধার করা হইবে, যতদূর সম্ভব তাহাদিগকে বিবাহ দিতে হইবে।
যদি হিন্দু সমাজ দূরদৃষ্টির সহিত বর্তমান বিপদ উদ্ধার হইতে না পারে, তবে ইহার ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন।
আমি চৌমুহনী ও নোয়াখালিতে উদ্ধার ও পুনর্বসতির জন্য প্রতিনিধিমূলক একটি কমিটি গঠন করিয়াছি। উপযুক্ত প্রহরায় ৫ জন করে স্বেচ্ছাসবকের ১০টি দল উপদ্রুত অঞ্চলের অভ্যন্তরে যাত্রা করিবে।
আমি এই বিবৃতিতে পূর্ববঙ্গের একটি ক্ষুদ্র অংশের অবস্থা মাত্র বিবৃত করিয়াছি। আমরা যাহা দেখিয়াছি ও শুনিয়াছি, সভ্য শাসনের ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই। বাংলার অন্যান্য অংশে অবস্থা অতি উত্তেজনাপূর্ণ এবং কলকাতাসহ কয়েক স্থানেই হাঙ্গামা চলিতেছে। শাসনযন্ত্র সম্পূর্ণ রূপেই ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে এবং ইহার জন্য গভর্ণর ও মন্ত্রীসভা ই দায়ী।
আমরা বরাবর সতর্ক করিয়াও বিফল হইয়াছি। আমরা ভালোভাবেই দেখিতে পাইতেছি যে, বর্তমান শাসন অব্যাহত থাকিলে এই প্রদেশে ধন-প্রাণ আরও বিপন্ন হইবে।
এই বিপদের সময় হিন্দুদিগকে এই কথাটি হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে যে, তাহারা যদি সঙ্ঘবদ্ধ না হয়, তবে তাহাদের ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হইবে। সম্ভবত বিধাতার এই অভিপ্রায় যে, বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস হইতেই হিন্দুদের সত্যিকার জগরণ আসিবে।
এই দুঃসময়েও আমরা যেন ভুলিয়া না যাই যে, আমরা ৩ কোটি হিন্দু (১৯৪৬ সালে) বাংলাদেশে বাস করিতেছি। আমরা যদি সঙ্ঘবদ্ধ হই এবং আমাদের একটি অংশ যদি কোনো বিপদেই ভ্রুক্ষেপ না করিয়া দৃঢ় সংকল্পের সহিত সংকটের সম্মুখীন হইতে প্রস্তুত হয়, তবে আমরা সমস্ত আক্রমনকারীকে পরাভূত করিয়া আমাদের মাতৃভূমিতে আমাদের সম্মানের আসন পুনরাধিকার করিতে পারিব।"
নোয়াখালির পর বিহার ছিলো মুসলিম লীগের পরিকল্পনায় :
হিন্দুদের গায়ে যদি মুসলমানদের মতো জানোয়ারের রক্ত থাকতো, তাহলে নোয়াখালির হিন্দু হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের যেসব স্থানে মুসলমানরা বর্তমানে সংখ্যালঘু, সেসব স্থানে আজ একটাও মুসলমান খুঁজে পাওয়া যেতো না। এটা মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক যে, নোয়াখালির প্রতিক্রিয়াতেই বিহারে দাঙ্গা হয়েছে; এমন হলে সারা ভারতেই তা হতো এবং এটা হলে বর্তমান ভারত মুসলিম শূন্য হতো, যেমন হয়েছে ভারতীয় পাঞ্জাব। কিন্তু তা হয় নি। বিহারের দাঙ্গা শুরু হওয়ার কারণ সম্পর্কে কৃপালনী, তার 'গান্ধী: হিজ লাইফ এণ্ড থট' গ্রন্থের ২৬৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন , "নোয়াখালির হিন্দুদের প্রতি সমবেদনা জানাতে ২৪ অক্টোবর, ১৯৪৬; ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নিষ্প্রদীপ দিওয়ালী পালন করা হয়েছিলো। বিহারের হিন্দুরাও দিওয়ালীতে প্রদীপ জ্বালাবার চিরাচরিত প্রথা বর্জন করেছিলো। কিন্তু মুসলমান নেতাদের উস্কানিতে মুসলমান মহল্লাগুলোতে আলো জ্বালিয়ে 'নোয়খালিতে হিন্দু হত্যার সফল অপারেশনে' বিজয় উৎসব পালন করা হয়। পরের দিন অর্থাৎ ২৫ তারিখ, হিন্দুরা মুসলমান নেতাদের কাছে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে গেলে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।"
আরও একটি ঘটনায় বিহারের দাঙ্গা গতি পায়। মুসলিম লীগ, নোয়াখালির সফল অপারেশনের পর বিহারসহ সারা ভারতের হিন্দুদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে প্রচার চালাচ্ছিলো যে, কংগ্রেস হিন্দুদের দল এবং কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের উপর স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে। বিহার ও তখন কংগ্রেস শাসিত রাজ্য। এভাবে হিন্দুদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য নোয়াখালির পর বিহারের মাটিও প্রস্তুত করা হচ্ছিলো এবং যত দিন না পাকিস্তান আদায় হচ্ছে, ততদিন এই ধরণের দাঙ্গা চলতেই থাকবে ব’লে - পাঞ্জাব আইন সভার সদস্যা বেগম শাহ নেওয়াজ এবং ১৬ আগস্ট, কলকাতার ডাইরেক্ট এ্যকশন ডে তে লুটের মাল বহনের জন্য ট্রাক সরবরাহকারী, বর্তমানে বাংলাদেশের ইস্পাহানি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মালিক এ.এইচ ইস্পাহানি- আমেরিকায় গিয়ে ২৯ অক্টোবর, ১৯৪৬ তারিখে প্রকাশ্য জনসভায় - তা উল্লেখ করে। পাকিস্তান সৃষ্টির যৌক্তিকতা আমেরিকানদের বোঝানোর জন্য মুসলিম লীগ, এই দুজনকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলো। এমন পরিস্থিতিতে সংখ্যায় বেশি হলেও হিন্দুরা মুসলমানদের কাছে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলো। এছাড়াও ১৬ আগস্ট কলকাতার গার্ডেনরিচ-ওয়াটগঞ্জে যে ৭০০ হিন্দুকে খুন করা হয়েছিলো, তাদের বেশিরভাগই ছিলো বিহার থেকে আসা কুলি ও শ্রমিক। এদের আত্মীয়-স্বজনরা মুসলমানদের উপর আগে থেকেই ক্ষেপে ছিলো। ঠিক ঐ সময় মুসলমানরা উসকানি দিলে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু বিহার, নোয়াখালির পথে চললো না। মুসলিম লীগের আশা ধুলিসাৎ করে মুসলমানরা সেখানে মার খেতে লাগলো। মুসলিম লীগ নেতৃত্ব চোখে সর্ষে ফুল দেখলো, কংগ্রেস নেতৃত্ব প্রমাদ গুনলো।
১৬ আগস্ট, কোলকাতাতে হিন্দু হত্যা শুরু হয়েছিলো, এরপর ১০ অক্টোবর শুরু হয় নোয়াখালিতে, ভয়াবহ নির্যাতন চলে কমপক্ষে পরবর্তী আরো ২০ দিন; এর রেশ যে কত দিন চলেছিলো, তার তো কোনো হিসেব নেই; হয়তো সেই রেশ চলছে আজও। যা হোক, ১৬ আগস্ট থেকে ২৫ অক্টোবর, দীর্ঘ এই ৭০ দিন, গান্ধী বা নেহেরু কেউ বাংলায় আসার প্রয়োজন বোধ করে নি, নিজেরা আসতে না পারলেও কোনো নেতা মন্ত্রীকে তো পাঠাতে পারতো, সেই চিন্তাও তারা করে নি। কারণ, বাংলায় মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা মরছিলো, আর হিন্দুরা মরলে তাতে নেহেরু বা গান্ধীর তো কিছু যায় আসে না। কিন্তু ২৫ অক্টোবর যেই বিহারে দাঙ্গা শুরু হয় এবং পরিস্থিতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেতে থাকে, তখনই গান্ধী, ২৯ অক্টোবর প্রথমে ছুটে আসে কলকাতায়। যদিও তখন প্রচার করা হচ্ছিলো যে, গান্ধী নোয়াখালিতে যাবে, কিন্তু কলকাতায় পৌঁছার পর পরই গান্ধীর আসার আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ হয়ে যায়। কারণ, গান্ধী নোয়াখালি যাবার পরিকল্পনা বাতিল করে বিহার যেতে চেয়েছিলো। ৩ নভেম্বর, নেহেরুও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার চার জন সদস্যকে নিয়ে বিহার চলে এলো। পাঠক, স্মরণ করুন, বাংলায় হিন্দুরা যখন অসহায় নিরস্ত্রভাবে মার খাচ্ছিলো, এই নেহেরুই শ্যামাপ্রসাদের আবেদনকে নাকচ করে বলেছিলো, "রাজ্যের অভ্যন্তরীন বিষয়ে কেন্দ্র কোনো হস্তক্ষেপ করবে না।" কিন্তু এই সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের তৎপরতা কি তাদের বিহার প্রীতির পরিচয় , না নিজ দোষে বিহারে যারা মার খাচ্ছিলো, সেই মুসলমান প্রীতির পরিচয়?
নেহেরু ও গান্ধী, তথা কংগ্রেসের এই দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করে সেই সময় পত্র পত্রিকায় অনেক চিঠি প্রকাশিত হয়েছিলো। জনৈক সি.এল মেহেতার লেখা একটি চিঠি ১ নভেম্বর, অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেছিলো। সেই চিঠিটি এখানে উল্লেখ করছি :
"তথাকথিত জাতীয় সরকার হয়তো একটা নতুন যুগের সূচনা করতে চাইছে। সাম্প্রদায়িক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের নিরপেক্ষ রাখার অদ্ভুত নীতি মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে। উত্তর পশ্চিম সীমান্তে কোনো একজন মুসলমানের সামান্য রক্তপাত হলে নেহেরু হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চিৎকার শুরু করেন। কাশ্মির সরকার, মুসলমান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর দু একটি গুলি ছুড়লেই নেহেরু তার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু হায়দ্রাবাদে হিন্দুদের উপর অত্যচার বা বাংলার নোয়াখালিতে হিন্দু নিধনের ঘটনা নেহেরু ও তার সহকর্মীদের মধ্যে বিন্দু মাত্র অনুকম্পার সৃষ্টি করে না, পাছে তারা সাম্প্রদায়িক হয়ে যান !"
বিহারের দাঙ্গার ভয়াবহতায় মুসলিম লীগ নেতারা হতভম্ব হয়ে পড়লো। নোয়াখালির হিন্দু নিধনের পর পর যা হয় নি, বিহারে মুসলমানদের উস্কানিতে নতুন করে দাঙ্গা শুরু হওয়ায় একই সাথে বোম্বে, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশেও ব্যাপক হিন্দু প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। নোয়াখালির হিন্দু নিধন শুরুর আঠারো দিন পর মুসলিম লীগ তাদের বিবৃতি প্রকাশ করেছিলো, সেটাও যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্তাকারে এবং প্রকৃত সত্যকে আড়াল নয়, অস্বীকার করে। কিন্তু বিহারের বেলায় তারা বিবৃতি দিতে দেরি করলো না।
সবচেয়ে অসহায় অবস্থা ছিলো জিন্নার। ডাইরেক্ট এ্যাকশনের সময় তার গলায় যে ঔদ্ধত্য ছিলো, এবার তার আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না। নোয়াখালিতে হিন্দু নিধন তাকে উৎফুল্ল করেছিলো। কিন্তু বিহারের তীব্র হিন্দু প্রতিক্রিয়া জিন্নাকে বিহ্বল করে দিয়েছিলো।
নেহেরু বিহারের বিস্তীর্ণ এলাকা ভ্রমণ করলো। তার মন্ত্রীসভার অর্থমন্ত্রী, লিয়াকত আলীকে নিয়ে বেশ কয়েকটি শান্তি সভায় ভাষণ দিলো। কিন্তু হিন্দুদের দুর্ভাগ্য, নেহেরু, নোয়াখালির পরিকল্পিত হিন্দু নিধন সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করলো না। মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি শব্দও মুখ থেকে বের করলো না। বরং নোয়াখালির হিন্দু নিধনের খবরকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করে হিন্দুদের অকারণে উত্তেজিত করার জন্য সে সংবাদপত্রগুলোকে দায়ী করলো। নেহেরু বলেছিলো, "কিছু লোক মনে করছে যে তারা পূর্ববঙ্গের অত্যাচারের বদলা নিচ্ছে। সেটা খারাপ ছিলো। কিন্তু সংবাদপত্রে অতিরঞ্জিত খবর বের করা হয়েছিলো। এর জন্য দোষীদেরকে কঠোর শাস্তি দেওয়া দরকার।" নেহেরুর এই হুমকি টি পাওয়া যাবে ৫ নভেম্বর, ১৯৪৬ এর অমৃত বাজার পত্রিকায়।
সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে শুধু উপরের ঐ কথা বলেই ক্ষান্ত হলো না নেহেরু। ৬ নভেম্বরের, এক জনসভায়, বিহারের সমস্ত হিন্দু এলাকাগুলি বোমা ও মেশিনগান চালিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিলো সে। রাজার হুমকি পালন হয়েই থাকে। পুলিশ ও মিলিটারি গুলি করে বিহারের ২০০ হিন্দুকে মেরে ফেললো।
বিহারের দাঙ্গা দমনের যুক্তি দিয়ে নেহেরু তথা কংগ্রেস বললো, "কোনো সরকার এই ধরণের অরাজকতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না।" অমৃত বাজার পত্রিকা ১০ নভেম্বর, তারিখে নেহেরুর এই নীতিকে পৌঁছে দিলো সারা ভারতে। কিন্তু মাত্র ২৫ দিন আগে নোয়াখালিতে যখন হিন্দুদের মারা হচ্ছিলো, তখন নেহেরুর এই নীতির জন্ম হয় নি। তখন নেহেরুর নীতি ছিলো, রাজ্যের অভ্যন্তরীন বিষয়ে কেন্দ্র হস্তক্ষেপ করবে না।
নেহেরুর দুমুখো নীতি দেখে, গান্ধীও মৌনী বাবা হয়ে বসে রইলো না। নোয়াখালির অসহায় মেয়েদের উদ্দেশ্যে গান্ধীর উপদেশ ছিলো, "তারা যেন মুসলমানদের বাধা না দিয়ে সাহসের সাথে মুসলমানদের তরবারির নিকট আত্মসমর্পন করে।" কিন্তু বিহারের বেলায় গান্ধী তার অহিংসার নীতি ভুলে, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে যে কোনো মূল্যে, হ্যাঁ যেকোনো মূল্যে বিহারের দাঙ্গা থামানোর নির্দেশ দিলো। শুধু তাই নয়, বিহারে মুসলমানদের উপর অত্যাচার হয়েছে, এর প্রতিবাদের গান্ধী তার খাওয়া কমিয়ে দিতে শুরু করলো এবং হুমকি দিলো অবিলম্বে দাঙ্গা বন্ধ না হলে সে আমৃত্যু অনশন শুরু করবে।
কি চমৎকার খেলা ! নোয়াখালিতে যখন হিন্দুরা মরছিলো, লোক জন গিয়ে তাকে বললো, এই সব অসহায় হিন্দু নর-নারীদের জন্য কিছু করুন। তখন গান্ধী বলেছিলো, এখন তার কর্তব্য কর্ম কী, তা সে বুঝতে পারছে না বা তার কর্তব্য সম্পর্কে ঈশ্বর তাকে এখনও নির্দেশ দেয় নি।" কিন্তু বিহারে মুসলমান মরার সময় গান্ধী চটপট বুঝে ফেললো তার কর্তব্য কর্ম কী ! এবং সেভাবে নির্দেশও দিয়ে দিলো। জাত ভাই বলে কথা। তাই ভাইয়ের বিপদে কী কর্তব্য তা বোঝার জন্য বেশি দেরি করতে হয় নি।
শেষ পর্যন্ত নভেম্বরের ৫ বা ৬ তারিখে গান্ধী নোয়াখালি পৌঁছে। নিশ্চয় হিন্দুদের বাঁচাতে নয়; কারণ, সে তো আগেই বলে দিয়েছিলো, মুসলমানদের বাধা না দিয়ে তাদের তরবারির সামনে হিন্দুদেরকে সাহসের সাথে আত্মসমর্পন করতে; আর মেয়েদের বলেছিলো, ধর্ষণের সময় মুসলমানদের সাহায্য করতে। তাই মনে হয়, আর কোনো হিন্দু এখনও বেঁচে আছে কিনা বা কোনো হিন্দু মেয়ে এখনও অক্ষত আছে কি না, সেটা দেখতেই গান্ধী নোয়াখালিতে গিয়েছিলো। কিন্তু যেহেতু গান্ধীর পুরো জীবন ই ভণ্ডামী আর মিথ্যার আবরণে ঢাকা, সেই মিথ্যার তলে চাপা পড়ে অনেকেই মনে করে গান্ধী নোয়াখালির হিন্দুদের বাঁচাতে এসেছিলো এবং বাঁচিয়েছিলো। এছাড়াও গান্ধী নোয়াখালিতে পৌঁছার আগেই হিন্দুরা যা হারাবার তা হারিয়েছিলো এবং মুসলমানরা যা জয় করবার তা করে নিয়েছিলো। ফলে নতুন করে কিছু হারাবার বা জয় করবার কারো কিছু ছিলো না। তখন হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো শুধু খাদ্য ও খাদকের। মুসলমানরা পাইকারি হারে ভোগ করছিলো আর হিন্দুরা ভক্ষিত হচ্ছিলো। এই অবস্থা থেকেই সেনাবাহিনীর লোকজন হিন্দু নর-নারীদের উদ্ধার করে কলকাতায় নিয়ে আসে। কিন্তু আক্রমন কারী মুসলমানদের তারা টাচও করে নি।
কিন্তু গান্ধীর নোয়াখালিতে পৌঁছার ৬ দিন পর, ১১ তারিখ অমৃত বাজার পত্রিকা একটি খবর ছাপিয়েছিলো, সেই খবরে বলা হয়েছিলো, "বিহারের মূখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ভাইসরয়কে জানিয়েছিলো, "বিহারের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অত্যন্ত কঠিন, যতক্ষণ না পূর্ববঙ্গের (নোয়াখালি) পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে।" এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, গান্ধীর নোয়াখালি সফর, সেখানে তার নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কেনো কাজেই আসে নি।
সুতরাং কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার এটা খুব ভালো করেই বুঝেছিলো যে, নোয়াখালির হিন্দু নিধন বন্ধ না হলে বিহারের মুসলিম নিধন বন্ধ করা যাবে না। কারণ, একবার শুরু হয়ে যাওয়ার পর, পুলিশ-মিলিটারি যতই হিন্দুদের গুলি করে মারুক, বিহারের দাঙ্গা ছিলো নোয়াখালির হিন্দু নিধনেরই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া; নোয়াখালি বন্ধ না হলে বিহার চলতেই থাকবে। তাই নোয়াখালির পরিস্থিতি উন্নয়নে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, ১৮০০ সৈন্য, ৬০০ সশস্ত্র পুলিশ, ১৩০ সাধারণ পুলিশ এবং এয়ারফোর্সের বিমান কাজে লাগিয়ে নোয়াখালির হিন্দুদের উদ্ধার করে এবং পরিস্থিতিকে শান্ত করে, এর পর পরই বিহার শান্ত হয়ে আসে।
নোয়খালি ও বিহারের কিছু তুলনামূলক চিত্র :
নোয়খালির হিন্দু নিধন যজ্ঞের প্রতিবাদে বিহারের দাঙ্গা ছিলো সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত | কোনো মৌলবাদী পরিকল্পনা এর পেছনে ছিলো না। নোয়াখালিতে জিহাদীদের সঙ্গী হতো মোল্লা ও মৌলভীরা। প্রাণের বিনিময়ে সেখানে তারা হিন্দুদের ইসলামে দীক্ষিত করতো। কিন্তু বিহারে এমন একটি ঘটনাও ঘটে নি, যেখানে কোনো মুসলমানকে হিন্দু বানানো হয়েছে। একটি মসজিদও বিহারে ধ্বংস বা অপবিত্র করা হয় নি।
নোয়াখালিতে হিন্দুদের বাঁচার প্রধান শর্ত ছিলো ইসলাম গ্রহন ও গোমাংস ভক্ষণ। কিন্তু বিহারে এমন ঘটনা ঘটেনি এবং কোনো মুসলমানকে জোর করে শুয়োরের মাংস খাওয়ানো হয় নি।
নোয়াখালির হিন্দু নিধন যজ্ঞের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো মেয়েদের উপর অত্যাচার। কিন্তু বিহারে মুসলমান মেয়েদের অপহরণ বা ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটে নি।
বিহারে দাঙ্গাপীড়িত মুসলমানদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো মুসলমান মন্ত্রীকেই। কিন্তু নোয়খালিতে এরকম কোনো ঘটনা ঘটে নি। শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত গান্ধী, হিন্দুদের জন্য কিছু করতে চাইলেও মুসলমানরা তাকে পদে পদে বাধা দিয়েছে।
উপসংহারে মুসলমানদের নৈতিক পরাজয়ের একটি ঘটনা:
এই ঘটনাটিও সেই যুবকের বর্ণনা করা, যে তার মামাতো বোনকে বিয়ে করে
মুসলমানদের চোখে ধুলা দিয়ে তার মামাতো বোনকে রক্ষা করেছিলো। উল্লেখ করছি উনার
বয়ানেই :
"আমরা তো মুসলমান হয়ে গেলাম। ওরা বললো, তোমরা মুসলমান হয়ে গেছো ঠিকই, কিন্তু গরুর গোশত তো খাও নি ? তবে তোমাদের গরুর গোশত খাওয়ার অভ্যাস
যেহেতু নেই, তাই আগে আমরা
এক সাথে সিন্নি খাবো, তারপর গোশত
খাবো। আমরা প্রায় দুই হাজার লোক এক সাথে সিন্নি খেতে বসেছি। এমন সময় কে এসে খবর
দিলো, শিখ এসেছে।
পূর্ব বাংলার মুসলমানরা শিখদের খুব ভয় পেতো। বিশেষ করে কলকাতা দাঙ্গার সময় শিখরা যে
বিক্রম দেখিয়েছিলো, সে কথা তখন
গ্রামে গ্রঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছিলো। তাই শিখ আসছে শুনলেই মুসলমানরা 'আল্লা হো আকবর' ধ্বনি দিয়ে অন্যান্য মুসলমান
গ্রামগুলিকে সতর্ক করার জন্য পালিয়ে যেতো। যাই হোক, সেদিনও শিখ আসছে শুনেই মুসলমানরা বলতে শুরু করলো, তোমরা কেউ মুসলমান হও নি। তোমরা সব
হিন্দুই আছো। তারপর দিলো দৌড়।
আসলে হয়েছিলো কি, চৌমুহনী স্টেশনে এক ওয়াগন লোহার রড এসেছিলো। পূর্ব বাংলার লোকেরা লোহার রডকে বলে শিক। সেই কথাটাই মুখে মুখে রটে যায় যে, শিখ এসেছে।"
এইভাবেই মুসলমানরা চিরদিন নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে, কিন্তু গায়ের জোরেই তারা তাদের বিজয়কে ধরে রেখেছে। তাই মুসলমানদের দমন করার একমাত্র উপায় হচ্ছে গায়ের জোর বাড়ানো আর তরোয়ালকে তরোয়াল দিয়েই প্রতিহত করার মানসিকতা অর্জন; তাহলেই মুসলিম আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাবে হিন্দু সমাজ ও হিন্দু ধর্ম।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রী রাম। জয় শ্রী কৃষ্ণ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন