এখনও বেশির ভাগ হিন্দু বিশ্বাস করে- রাধা বলে
কেউ ছিলো এবং তার সাথে কৃষ্ণের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, তাহলে
এর সুযোগ নিয়ে মুসলমানরা কৃষ্ণ সম্পর্কে কটূক্তি করবে না কেনো ? রাধার প্রকৃত সত্য জানতে হলে
পড়ুন নিচের এই প্রবন্ধটি-
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, সত্য না কল্পকাহিনী ?
মূল মহাভারত, চার বেদ, ১০৮টি উপনিষদ, গীতার ১৮টি অধ্যায়ের ৭০০ শ্লোক এবং বিষ্ণু পুরান- কোথাও রাধার কোনো উল্লেখ
নেই। এই সমস্ত বিষয়, বিচার-বিশ্লেষণ করে, সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, তার "কৃষ্ণ
চরিত্র" গ্রন্থে এক বিশাল প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছেন,
"তাহা হইলে, এই রাধা আসিলেন কোথা হইতে ?"
রাধার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রে যথেষ্ট কালিমা লেপন
করা হয়। কৃষ্ণকে বিশ্বপ্রেমিক প্রমান করতে বলা হয় কৃষ্ণলীলা; আবার কেউ কেউ নিজেদের লাম্পট্যকে ঢাকা দেওয়ার জন্য কৃষ্ণেরউদাহরণ টেনে
অপরকে প্রশ্ন করে বলে, "কৃষ্ণ করলে লীলা, আর আমরা করলে
বিলা ?" এই ব্যাপারটি এতদূরগড়িয়েছে যে, এ নিয়ে গানও বানানো হয়েছে -
"কৃষ্ণ, করলে লীলা, আমরা করলে বিলা" -শিরোনামে।
পশ্চিমবঙ্গের এক গায়ক তো তার গানে বলেছে,
"যমুনারও ঘাটে যাইও না গো রাধা
ওইখানেতে বইস্যা আছে, কানু হারামজাদা।"
এগুলো ছাড়াও রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে সমগ্র বাংলা এলাকায় আরো অনেক গান কবিতা আছে, যেগুলোর বেশির ভাগই আদি রসাত্মক এবং সেগুলো কৃষ্ণ চরিত্রের নেগেটিভ দিকই
প্রকাশ করে।
এছাড়াও বলা হয়, কৃষ্ণ শুধু রাধার সাথেই প্রেম করে নি, সে নাকি
প্রেম করেছে, রাধার সখীদেরও সাথে। রাধার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও তো এই ব্যপারটা
একেবারে অসম্ভব। কারণ, কৃষ্ণ রাধার সাথে প্রেম করা কালীন, রাধার সখীদের
সাথেও প্রেম করবে, আর সেটা রাধা মেনে নেবে, এই তত্ত্ব শুধু নির্বোধদের
পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব। কারণ, বিশ্বাস না হলে, আপনি যদি পুরুষ হন, একই সাথে, একে অপরের বান্ধবী, এমন ২/৩ জন মেয়ের
সাথে প্রেম করে দেখেন আর তারপর তাদের হাই হিলের আঘাতে আপনার শরীরের
অবস্থা দেখেন, তাহলেই নিজের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারবেন, রাধার সাথে
প্রেম করা কালীন, কৃষ্ণ, রাধারঅন্য সখীদের সাথেও প্রেম করেছিলো কি না ?
এবার বঙ্কিমচন্দ্রের সেই লাখ টাকার প্রশ্নে ফিরে যাই, "তাহা হইলে, এই রাধা আসিলেন কোথা হইতে ?"
ব্যাকরণ দিয়েই শুরু করি, যিনি আরাধনা করেন, তাকে এক কথায় বলা হয় রাধা। এই সূত্রে পৃথিবীর সমস্ত নর-নারী, যারা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভজনা বা আরাধনা করেন, তারা রাধা।
কিন্তু রাধা শব্দটি নারীবাচক হলো কিভাবে ?
জীবাত্মা বা মানুষ যখন, পরমাত্মা বা ভগবানের কাছে
প্রার্থনা করে, তখন শক্তিশালী ভগবানের কাছে মানুষ- হীন, দুর্বল ও
অসহায়। মেয়েরা অন্যভাবে নেবেন না, আমাদের সামাজিক বাস্তবতাতেও
শক্তিশালী পুরুষের কাছে নারীরা এমনই-হীন, দুর্বল ও
অসহায়। এভাবে দুর্বল ও অসহায় মানুষ, যারা নারীর
প্রতীক, তাদের বোঝাতে রাধা শব্দটি নারীবাচক শব্দে পরিণত হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
যেহেতু একজন পুরুষ এবং তার ভজনা বা আরাধনাকারীরা যেহেতু রাধা এবং কার্যকারিতার দিক
থেকে রাধা যেহেতু একটি স্ত্রীবাচক শব্দ, তাই
পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার এই আত্মসমর্পণ, কৃষ্ণের
প্রতি রাধার আত্মসমর্পনের রূপ পেয়েছে এবং বিরহের প্রচণ্ড ব্যাকুলতা ছাড়া ভগবান
শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই রাধা
রূপী জীবাত্মা, ক্রমে ক্রমে ভক্ত মানসে নারী রূপী রাধায় পরিণত হয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। আর
আমরা সনাতন ধর্মীরা যেহেতু, বেদ এ বর্ণিত দেবতাদের রূপ ও তাদের কার্যপ্রণালীকে কল্পনায় নিয়ে ঐসব
দেবতাদের মূর্তি তৈরি করতে খুব পারদর্শী, সেহেতু
আধ্যাত্মিকভাবে প্রতীকী রাধাকে খুব সহজেই রক্ত মাংসের নারী বানিয়ে কৃষ্ণের পাশে
দাঁড় করিয়ে দিয়েছি।
মহাভারত, যা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে লেখা, যা কৃষ্ণের
প্রামান্য জীবনী, তাতে রাধার কোনো উল্লেখ নেই; সুতরাং
গীতাতেও রাধার কথা থাকা সম্ভব নয়। এমন কি বিষ্ণু পুরান, যে বিষ্ণুই কৃষ্ণরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন, সেই পুরানেও
রাধার কোনো উল্লেখ নেই।কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানের মতো কিছু অর্বাচীন বা নতুন
পুরানে রাধা উল্লেখ আছে, এর কারণ কী ? এছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলী, যা রাধার, কৃষ্ণের প্রতি প্রেম বিরহ নিয়ে লেখা একাধিক কবির পদ্য এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
কাব্য, যা মূলত একটি যাত্রাপালা, যাতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম
একেবারে মাখামাখি, কৃষ্ণকে নিয়ে এসব রস সাহিত্য সৃষ্টিরই বা কারণকী ?
কিছু আধুনিক পুরান এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রাধার উপস্থিতিকে
প্রামান্য করার জন্যও অবতারণা করা হয়েছে নতুন কাহিনীর। যার বিস্তৃতি স্বর্গ থেকে
মর্ত্য পর্যন্ত। এই কাহিনী অনুসারে, পৃথিবীতে
রাধার বিয়ে হয়েছিলো নাকি আয়ান ঘোষ নামের এক ব্যক্তির সাথে, এই আয়ান ঘোষ নাকি ছিলো আবার নপুংসক এবং ছিলো কৃষ্ণের মামা। কৃষ্ণ যেহেতু
জন্মের পর এক ঘোষ পরিবারে লালিত পালিত হয়েছিলো, তাই কাহিনীটি
খুব সহজেই মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলো। এই সূত্রে রাধা ও কৃষ্ণের সম্পর্ক
আবার মামী ও ভাগনা। মামীর সাথে ভাগনার প্রেম, এটাও আবার এক
ন্যাক্কারজনক ঘটনা, যার কালিমা লেপন করা হয় কৃষ্ণের চরিত্রে।
আয়ান ঘোষ কেনো নপুংসক হলো এবং কৃষ্ণ কেনো মামীর সাথে প্রেম করতে গেলো, এই ব্যাখ্যাকে যুক্তিসংগত করার জন্য এই কাহিনীতে আছে একটি স্বর্গীয় অধ্যায়; সেটি এরকম:
ভগবান বিষ্ণু, যিনি নারায়ণ নামেও পরিচিত, তার স্ত্রী লক্ষ্মী। এজন্যই বলা
হয় লক্ষ্মী-নারায়ণ, অর্থাৎ এরা এক জুটি।স্বর্গের কোনো এক দেবতা, বিষ্ণুর নিকট
থেকে, যেকোনোভাবেই হোক - এই বর পায় যে, পৃথিবীতে
মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর, সে বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মীকে
বিয়ে করতে পারবে; কেননা, সেই সময় লক্ষ্মীও নারী রূপে পৃথিবীতে জন্ম নেবে। বিষ্ণুর স্ত্রী এই
লক্ষ্মীই হলো রাধা এবং সেই দেবতা হলো আয়ান ঘোষ।
এখন, আয়ান ঘোষরূপী ঐ সাধারণ দেবতা এবং রাধারূপী লক্ষ্মীর মধ্যে বিবাহ হলে তো
দুজনের মধ্যে যৌনসম্পর্ক অনিবার্য। কিন্তু বিষ্ণু, যিনি ভগবান, তার স্ত্রীর সাথে তো অন্য কোনো দেবতার যৌন সম্পর্ক হতে পারে না, আবার বিষ্ণু নিজেই যেহেতু সৃষ্টিকর্তা এবং আয়ান ঘোষ হিসেবে ঐ দেবতাকে
পৃথিবীতে সৃষ্টি করার দায়িত্বও তারই, তাই বিষ্ণু, আয়ান ঘোষকে পৃথিবীতে জন্ম দিলেন যৌনক্ষমতাহীনভাবে, যাতে সে রাধা অর্থাৎ লক্ষ্মীর সাথে বিয়ের পর কোনো যৌনসম্পর্ক না করতে পারে।
এই সময় বিষ্ণুও পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন কৃষ্ণ রূপে এবং রাধার সাথে লীলা করলেন।
হিন্দু ধর্মের গ্রন্থের বহর এত বিশাল যে, এক জীবনে এর
সবকিছু আয়ত্ব করা খুব কম হিন্দুর পক্ষেই সম্ভব। হিন্দু সমাজের এই দুর্বলতার সুযোগে
এই ধরণের কাল্পনিক কাহিনীগুলো হিন্দু সমাজে ভাইরাসের মতো খুব দ্রুত ছড়িয়েছে, আর ১৮৬০/৭০ সালের আগে, বঙ্কিমচন্দ্রের মতো এই কাহিনীগুলোর
সত্যতা খুঁজে দেখারও কেউ তেমন চেষ্টা করে নি।আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, বঙ্কিমচন্দ্রের ঐ লাখ টাকার প্রশ্নের পর দেড়শ বছর কেটে গেলেও, কোনো হিন্দু ধর্মগুরু প্রকৃত সত্য উদঘাটন করে হিন্দু সমাজের এই ক্ষতগুলোকে
সারানোর চেষ্টা করে নি। তাদের শুধু লক্ষ্য ছিলো এবং এখনও আছে, শিষ্য সংখ্যা বাড়িয়ে তাদের টাকা দিয়ে নিজের পকেট ভরানো আর আশ্রমের
বাড়-বাড়ন্ত আরো বৃদ্ধি করা।রামকৃষ্ণ মিশনের বয়স প্রায় ১২০ বছর, ভারত সেবাশ্রম সংঘের বয়স প্রায় ৮০ বছর, এই সংগঠনগুলো
কি কখনো এগুলো নিয়ে কিছু ভেবেছে, না এ বিষয়ে কোনো কাজ করেছে ?
আর ইসকন ! ইসকনের বয়স প্রায় ৫০ হলেও, ওরা হিন্দু
ধর্মের এই সব ক্ষত সংস্কার করার পরিবর্তে, সাধারণ
হিন্দুদের ভেতরে রোপন করা ভ্রান্ত বিশ্বাসকে সার জল দিয়ে লালন করে, তাদের পকেট ফাঁকা করতেই বেশি ব্যস্ত।
মূল মহাভারতে রাধা না থাকলেও, ২০১৩/১৪ সালে
স্টার জলসা যে মহাভারত দেখিয়েছে, তাতে রাধাকে দেখানো হয়েছে- যদিও বালিকা অবস্থায় এবং খুব কম সময়ের
জন্য।কিন্তু মূলে না থাকলে, এখানে রাধা এলো কোথা থেকে ? শুনেছি, এর পেছনেও ছিলোইসকনের হাত। ইসকন ছিলো নাকি এই মহাভারতের এক ফাইন্যান্সার।
আর ইসকনের মূল পুঁজি যেহেতু রাধা-কৃষ্ণ এবং রাধা-কৃষ্ণকে অবলম্বন করেই ইসকন যেহেতু
গত ৫০ বছর ধরে তার সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, তাই ইসকন
মহাভারতের নির্মাতাদেরকে বাধ্য করেছে কাহিনীতে রাধার উপস্থিতি রাখতে। না হলে তাদের
বিজনেসেরভিত্তি নাকি ধ্বসে পড়ার সম্ভাবনা ছিলো।
এখন দেখা যাক, হিন্দু শাস্ত্রের আধ্যাত্মিক প্রতীকী রাধা কিভাবে জলজ্যান্ত মানুষে পরিণত
হলো। এই ঘটনাগুলো ঘটেছে, ভারতে মুসলিম শাসন আসার পর হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করতে, হিন্দুধর্মকে বিকৃত এবং হিন্দু দেবতাদের চরিত্র কালিমালিপ্ত করার
পরিকল্পানার অংশ হিসেবে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানসহ অশ্লীলপুরানগুলো, যেগুলোতে রাধার উপস্থিতি আছে, সেগুলো এই
সময়ে, মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়, মুসলিম
শাসকদেরকে খুশি করার জন্য লেখা।
বৈষ্ণব পদাবলী, যেখানে রাধার উপস্থিতি সবচেয়ে উজ্জ্বল, সেগুলো
চৈতন্যদেবের সময়ে এবং তার কিছু পরে লেখা। এগুলো মোটামুটি অশ্লীলতা মুক্ত, কিন্তু রাধা এখানে সম্পূর্ণভাবে রক্ত মাংসের মানুষ; পরমাত্মার প্রতি জীবাত্মার প্রেম, এই পদাবলী
লেখকদের হাতে পুরুষের প্রতি নারীর প্রেমে পরিণত হয়েছে।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, যেটা লেখা হয় ১৩৫০ থেকে ১৪০০
খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। বড়ু চন্ডীদাস নামে এক কবির লেখা এই কাব্যে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি।
কৃষ্ণ, এই কাব্যে সম্পূর্ণ এক লম্পট চরিত্র।রাধা-কৃষ্ণের প্রেম, যৌনতা নিয়ে আগে লেখা পুরানগুলো থেকে রসদ নিয়ে বড়ু চণ্ডীদাস যে এই কাব্য
লিখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হিন্দু
কবিরাই কেনো তাদের ধর্মের প্রধান পুরুষ, কৃষ্ণকে নিয়ে
এমন লেখা লিখলো ?
মধ্যযুগের সব মুসলিম শাসকদের সভায় হিন্দু কবি ছিলো। ইসলামে যেহেতু
কবিতা লিখা নিষেধ, তাই কোনো মুসলমানকে কবিতা লিখতে বলে বা তার কাব্য প্রতিভাকে বিকশিত করে, কোনো মুসলমান শাসক পাপের ভাগী হতে চাইতো না। এজন্য মুসলিম শাসকদের শাসন
কার্যের কোথাও হিন্দুদের কোনো জায়গা না হলেও এবং তারা পাইকারিভাবে জোর জবরদস্তি
করে সাধারণ গরীব হিন্দুদের মুসলমান বানালেও বা বানাতে চেষ্টা করলেও, জিজিয়া করের জন্য ধনী হিন্দুদের এবং কোনো কোনো মুসলিম শাসক ব্রাহ্মণ টাইপের
জ্ঞানী হিন্দু পণ্ডিতদের হিন্দুত্ব টিকিয়ে রাখতো রাজসভায় কাব্য আলোচনা এবং তা থেকে
রস আস্বাদনের জন্য। এভাবে যে সব হিন্দু, রাজসভায় কবি
হিসেবে নিয়োগ পেতো, ধর্মের উপর জোর জবরদস্তি না করার জন্য তারা মুসলমান শাসকদের উপর থাকতো খুবই
কৃতজ্ঞ এবং অনুগত। এই কবিদেরকে, তাদের পৃষ্ঠপোষক মুসলমান শাসকের
ফরমায়েশ এবং পছন্দ অনুযায়ী কবিতা লিখতে হতো। এই পছন্দকে পাত্তা দিতে গিয়ে এবং
মুসলমান শাসকদেরকে খুশি করতে গিয়েই হিন্দু কবিরা তাদের ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হিন্দু
ধর্মের মূল গ্রন্থগুলো সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করার সময় বিকৃত করেছে। কারণ, ঐ কবিদের পৃষ্ঠপোষক, মুসলমান শাসকদের খুশির উপরই নির্ভর ছিলো ঐ সব দুর্বল বেতন ভোগী হিন্দু
কবিদের জীবন জীবিকা। একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, বাংলা
সাহিত্যের যত হিন্দু ধর্মীয় পুস্তক, সংস্কৃত থেকে
বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই করা হয়েছে, মধ্যযুগের এই
মুসলিম শাসনের সময়।
উদাহরণ স্বরূপ, কৃত্তিবাসী রামায়ণের ব্যাপারে একটু আলোচনা করছি; সংস্কৃত রামায়ণে, সীতাকে যখন রাবন ধরে নিয়ে যায়; তখন সীতা, রাবনের সাথে ভয়ংকরভাবে সাহসের সাথে তর্ক বিতর্ক করে। কিন্তু কৃত্তিবাসী
রামায়ণে ঐ সময়ে সীতা একজন ভীরু ও দুর্বল মহিলা। কৃত্তিবাসী রামায়নে রামের চরিত্রও
দুর্বল করে দেখানো হয়েছে এবং তাকে নপুংসক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কেননা, কৃত্তিবাসী রামায়ণে, রামের চরিত্র নিয়ে এই প্রশ্ন উত্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে যে, রাম-সীতা বনে ১২ বছর এক সাথে থাকার পরেও কেনো সীতা গর্ভবতী হলো না ? কিন্তু সংস্কৃত রামায়ণের এই তথ্যকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে যে, বনবাসে যাওয়ার আগেই রাম সীতা প্রতিজ্ঞা করেছিলো, বনে গিয়ে তারা কোনো ভোগ-বিলাসে মত্ত হবে না; তারা বনবাস
কালীন ব্রহ্মচর্য পালন করবে। তো যারাব্রহ্মচর্য পালন করবে, তাদের সন্তান হবে কিভাবে ? এইভাবে মুসলিম আমলে অনুবাদিত
প্রত্যেকটি গ্রন্থ, সেটা ভারতের যে আঞ্চলিক ভাষাতেই হোক, তাকে কিছু না
কিছুবিকৃত করা হয়েছেই। রামায়ণ সম্পর্কে আরও একটা তথ্য এ প্রসঙ্গে আপনাদেরকে জানিয়ে
রাখি, বলা হয় রামের জন্মের ৬ হাজার বা ৬০ হাজার বছর পূর্বে বাল্মীকি মুনি রামায়ণ
রচনা করেন। এটা একটা ডাহা মিথ্য অপপ্রচার। বাল্মীকি মুনি, রামের সমসাময়িক এবং লংকার যুদ্ধ শেষে রাম অযোধ্যায় ফিরে আসার পর রামায়ণ
লেখা শুরু হয়। এটা আমার মত নয়, হিন্দু ধর্মের বই পুস্তক নিয়ে
যিনি বহু গবেষণা করেছেন এবং "হিন্দু ধর্ম, ভদ্রলোকের
ধর্ম" এই পরম সত্য যার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে, সেই ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, রামায়ণ রচনার
সময় নিয়ে উপরের ঐ মত ব্যক্ত করেছেন।
যা হোক, ইংরেজরা, মুসলমানদের মতো সরাসরি হিন্দুদের জীবন ওধর্মে আঘাত না করলেও, হিন্দু সংস্কৃতিকে সুকৌশলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা হিসেবে খ্রিষ্টান সমাজের
অনুরূপ ক’রেরাজা রাম মোহন রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদু প্রিন্স দ্বারাকানাথের
মাধ্যমে বা্রহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে। ব্র্রাহ্মদের আচার আচরণ খ্রিষ্টানদের মতো
হওয়ায়, সেই সময়ের নিষ্ঠাবান হিন্দুরা ব্রাহ্মদেরকে খ্রিষ্টানই মনে করতো। এই
ব্রাহ্মসমাজের নেতাদের পরামর্শে ইংরেজরা বেদকে বিকৃত করার পরিকল্পনা করে। ইতোমধ্যে
বাংলায় তারা ছাপাখানা স্থাপন করে ফেলেছিলো এবং সেখান থেকে প্রথম মুদ্রিত বই রূপে
বাইবেল প্রকাশ করেছিলো। এরপর তারা বেদ প্রিন্ট করে। সেই সময় অথর্ববেদের শেষের দিকে
অপ্রাসঙ্গিকভাবে কয়েকটি দুর্বল শ্লোক যুক্ত করে এবং তার মধ্যে আল্লাহ, মুহম্মদ এরকম কয়েকটি ইসলামিক শব্দটি ঢুকিয়ে দেয়; যেগুলোর মাধ্যমে জাকির নায়েক প্রমান করার চেষ্টা করে যে বেদ এ মুহম্মদের
কথা বলা আছে এবং মুহম্মদই কল্কি অবতার, সুতরাং জাকির
এর মতে হিন্দুদের উচিত, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যাওয়া। এছাড়াও অনেকে জানেন যে, ভবিষ্য পুরান লেখা হয়েছিলোসম্রাট আকবরের সময়ে এবং তাতেও ইসলামের এই সব বিষয়
ঢুকানো আছে, যা দ্বারা জাকির হিন্দুদেরকে বিভ্রান্ত করছে, আর মূল বিষয়
না জেনে হিন্দুরাওআমাদের ধর্মগুরুদের উদাসীনতায় বিভ্রান্ত হচ্ছে।
এই বিভ্রান্তি এড়াতে, হিন্দু ধর্মের মুল বিষয়গুলো
জানতে হলে পড়তে হবে সংস্কৃত গ্রন্থগুলো এবং তাও যথেষ্ট সতর্ক হয়ে- কারণ, ইংরেজ আমলে প্রথম প্রিন্ট হওয়া সংস্কৃত গ্রন্থগুলো হানড্রেড পার্সেন্ট
অবিকৃত নয়।
এভাবে মুসলিম আমলে অনুবাদিত এবং ইংরেজ আমলে ছাপা হওয়া গ্রন্থগুলোতে হিন্দু
ধর্মের প্রধান দেব-দেবী ও দেব পুরুষদের চরিত্রকে সুকৌশলে বিকৃত করে কালিমালিপ্ত
করা হয়েছে।
এবার যাওয়া যাক, স্টার জলসায় প্রচারিত মহাভারত অনুসারে, রাধা-কৃষ্ণের
প্রেমের যৌক্তিকতা প্রমানে। এতে, কৃষ্ণের বেড়ে উঠার স্থান, গোকুলের পাশের বৃন্দাবনে, কৃষ্ণের ৭ বছর বয়সের সময় রাধার
সাথে তার দেখা হয় এবং কৃষ্ণের ১০ বছর ২ মাস বয়সের সময়, কৃষ্ণ, কংসকে হত্যা করার জন্য গোকূল-বৃন্দাবনের সকল মায়া ত্যাগ করে মথুরা চলে যায়।
পরে কৃষ্ণ আর কোনোদিন বৃন্দাবনে যায় নি, আর রাধার
সাথে তার দেখাও হয় নি। রাধা, কৃষ্ণের সমবয়সী হলেও ৭ থেকে ১০
বছরের মধ্যে দুজনের দেখা সাক্ষাৎ। এই বয়সে দুজনে বালক বালিকার মধ্যে
প্রেম-যৌনতারঅনুভূতি কাজ করবে, না খেলার অনুভূতি কাজ করবে ? ১০ বছর বয়সে কোনো মেয়ের ঋতুচক্রও শুরু হয় না, আর ইস্টোজেন
হরমোনের প্রভাবে ঋতুচক্র শুরু না হলে কোনো মেয়ের মধ্যে প্রেমের অনুভুতি জাগতেই
পারে না, যেমন টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রভাবে কেনো ছেলের শরীরে বীর্যের উৎপত্তি না
হলে, তার মধ্যেও প্রেমের অনুভূতির সৃষ্টি হবে না। খুব এ্যাডভান্স হলেও একটি
মেয়ের প্রেমে পড়তে বয়স হতে হবে কমপক্ষে ১৪/১৫ এবং ছেলের ১৭/১৮। রাধা কৃষ্ণের
প্রেমের ক্ষেত্রে এই বাইলোজিক্যাল সাইন্সও কি মেলে ?
এরপর উপরে আয়ান ঘোষ সম্বলিত স্বর্গমর্তের যে কাহিনী বলেছি, সেটা একবার স্মরণ করুন। বিষ্ণু যদি কৃষ্ণ হয়ে রাধাকে সঙ্গ দিতেই পৃথিবীতে
আসে, তাহলে মাত্র ১০ বছর বয়সে কৃষ্ণ, রাধাকে ত্যাগ
করে চলে গেলো কেনো ? পরে তার সাথে আর দেখা করতে এলো না কেনো ? বা কৃষ্ণ, রাধাকে বিয়েই বা করলো না কেনো ?
যে ঘটনা মিথ্যা, তার মধ্যে কোনো না কোনো ফাঁক থাকবেই। এই ফাঁকটা ধরতে পারলেই আপনি বুঝতে
পারবেন, কৃষ্ণের প্রেমিকা হিসেবে পৃথিবীতে রাধা বলে আসলে কেউ কখনো ছিলো না।
হিন্দুদের উপলব্ধির ভুলে আধ্যাত্মিক রাধা যখন রক্ত মাংসেররাধায় পরিণত হয়, তখন এই রাধা গিয়ে পড়ে মুসলিম শাসকদের যাঁতাকলে এবং তার সাথে সাথে পিষ্ট হয়
কৃষ্ণও ।
এখানে আরো একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, সারা ভারতের
মধ্যে বৃন্দাবনের পর রাধার প্রভাব সবচেয়ে বেশী বাঙ্গালিদের মধ্যে এবং তারপর উড়িয়া
ও বিহারীদের মধ্যে। এর মূল কারণ মধ্যযুগের বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
যাত্রাপালা, এরপর বাংলায় চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এবং তার প্রভাবে বৈষ্ণব পদাবলী । কিন্তু
সারাভারত বাদ দিয়ে বাংলার বাইরে হিন্দি এলাকা হওয়া সত্ত্বেও মথুরা-বৃন্দাবনে রাধার
ঐ বিস্ময়কর প্রভাব পড়লো কিভাবে ?
প্রাচীন যুগে এক কৃষ্ণভক্ত রাজা, তার মায়ের
নির্দেশে, মথুরা
বৃন্দাবনে প্রথম কয়েকটি মন্দির নির্মান করে। আমার ধারণা, তখন সেই মন্দিরগুলোতে শুধু কৃষ্ণকেই পূজা করা হতো, যেহেতু মূল মহাভারতে রাধার কোনো উল্লেখ ছিলো না। এছাড়াও বৃন্দাবনে এমন কিছু
প্রাচীন মন্দির আছে, যেগুলো কৃষ্ণকে নয়, হিন্দু ধর্মের অন্যান্য দেবতাদেরকে রিপ্রেজেন্ট করে। মুসলিম শাসনামলে
বৃন্দাবনের প্রায় সকল মন্দিরই ধ্বংস করা হয় এবং সেগুলোকে তখন আর পুণনির্মান করতেও
দেওয়া হয় নি। ইংরেজরা ভারতে আসার পর, হিন্দুদের
ধর্মীয় মুক্তি ঘটলে সোমনাথ মন্দির সহ সকল ভগ্ন মন্দির পুননির্মান করা হয় এবং এর পর
বেশ কিছু বাঙ্গালি- বিহারী উদ্যোক্তা, যারা
চৈতন্যদেবের গভীর অনুরাগী, তারা বৃন্দাবনে মন্দির নির্মান করে এবং সেই মন্দিরগুলোতে কৃষ্ণের পাশে
রাধাকে বসিয়ে, স্বামী-স্ত্রীর যুগল রূপকে সুড়সুড়ি দিয়ে, রাধা-কৃষ্ণের
যুগল রূপের পূজা করতে শুরু করে, যাতে তীর্থ দর্শনে
স্বামী-স্ত্রী এক সাথে যায় এবং তাদের মন্দিরের বিজনেসটা ভালো হয়। কিন্তু
রাধা-কৃষ্ণ কি স্বামী-স্ত্রী ছিলো ? এছাড়াও চৈতন্যদেব, রাধা কৃষ্ণের যুগল অবতার ব'লে যে একটা
ধারণা তার ভক্তদের মধ্যে প্রচলিত আছে, বৃন্দাবনের
মন্দিরগুলোতে কৃষ্ণের পাশে রাধার শক্ত অবস্থানের এটাও একটা কারণ।
বৃন্দাবনের আশে পাশের গ্রামগুলোতে রাধার স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে অনেক লোককথা রয়েছে।
এ থেকে ধারণা করা যায় যে, এমনও হতে পারে, রাধা নামের কোনো এক মহিলার জন্ম ঐ এলাকাতে কোনো এক সময় হয়েছিলো। দেবতা
হিসেবেই কৃষ্ণের প্রতি ছিলো যার অগাধ প্রেম ও ভক্তি; যেমন নিকট
অতীতে ছিলো মীরা বাই নামের এক মহিলার, যেকৃষ্ণ
প্রেমে পাগল হয়ে বহু গান লিখে বিখ্যাত হয়ে গেছে, এমনকি সেই
মহিলা অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে পর্যন্ত করে নি। এখন কি এই মীরাকেও কৃষ্ণের সাথে
যুক্ত করে দুজনকে এক সাথে যৌন লীলায় ভাসাবো ? আবারও কি
আমরা লিখবো নতুন কোনো পুরান ?
এমনও হতে পারে, রাধা নামের কোনো মেয়ে কৃষ্ণের সময়েই বৃন্দাবনে জন্মেছিলো। কৃষ্ণের সাথে সে
খেলাধুলাও করেছিলো।কৃষ্ণের সময় তো অনেকেই বৃন্দাবন-গোকুলে জন্ম নিয়েছিলো, তাদের সবার নাম কি আর মূল মহাভারতে আছে ? উল্লেখযোগ্য
না হওয়ায় অন্যান্যদের মতো হয়তো রাধার নামও চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু কৃষ্ণ বৃন্দাবন
ত্যাগ করার পর হয়তোবাল্যকালের খেলার স্মৃতি স্মরণ করে যৌবনে বয়সে কৃষ্ণের জন্য
রাধার প্রেম জেগে উঠে, আর সেই কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে চারেদিকে। এটা অসম্ভব কিছু নয়; কারণ, কৃষ্ণ ছিলো সেই সময়ের সুপার হিরো।একবার ভাবুন, যে ছেলে মাত্র ৫ বছর বয়সে কালীয় নাগের মতো একটা ভয়ংকর সাপকে তার অলৌকিক
ক্ষমতা দ্বারা বশ করতে পারে, ১০ বছর বয়সে নিজের কণিষ্ঠা
আঙ্গুলের উপর গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরে রাখতে পারে, দেবরাজ
ইন্দ্রকে যে পরাজিত করতে পারে, কংসের মতো শক্তিশালী রাজাকে যে
কুস্তি লড়ে পরাজিত করে হত্যা ক’রে অলৌকিকভাবে নিজের
পিতা-মাতাকে জল্লাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে, সে সব কথাকে
মনে করে যেকোনো মেয়ের মধ্যে যে প্রেম জেগে উঠবে, তাতে আর
আশ্চর্য কী ? কিন্তু রাধার এই এক তরফা প্রেমের সাথে কৃষ্ণের কি কোনো যোগাযোগ আছে ? আর কৃষ্ণের চরিত্রকে, সেই রাধার মাধ্যমে কলুষিত করারও
কি কোনো সুযোগ আছে? একদমই নেই, যেহেতু রাধার সাথে কৃষ্ণের পরে আর দেখাই হয় নি।
আজও ঋত্বিকের মতো সুপারস্টারদের প্রেমে সারা বিশ্বের হাজার হাজার মেয়ে
হাবুডুবু খায়। প্রেম, বিয়ে দূরে থাক, তাদের মধ্যে কেউ যদি তাকে একবার স্বচক্ষে দেখারও সুযোগ পায়, তাতেও সে নিজেকে ধন্য মনে করে বা করবে। আর সকল নীতি নৈতিকতাকে শিকোয় তুলে
রেখে, ঋত্বিকের সাথে একটা রাত কাটাতে চায়, এমন মেয়েও
আছে শত শত। ঋত্বিকের মতো সুপারস্টারদের প্রতি মেয়েদের এই যে প্রেম, ভালোবাসা; এটা কি ঋত্বিকের দোষ, নাকি অর্জন ? কৃষ্ণও ছিলো এরকমই, তার সময়ের সুপার হিরো। সুতরাং কৃষ্ণের প্রতি রাধা বা মীরার ওই রকম প্রেম
থাকতেই পারে, তাতে তো কৃষ্ণের কিছু করার নেই। আর কৃষ্ণ সেরকম কিছু করেও নি।
এসব বিষয় থেকে দুটো সিদ্ধান্তে আসা যায়, কৃষ্ণের
বাল্যকালে রাধা বলে কোনো মেয়ে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু
কৃষ্ণের জীবনে সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না। তাই মহাভারতে
তার ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই। এই সূত্রে রাধার বাল্যকালটা ঐতিহাসিক চরিত্র হতে
পারে, কিন্তু তাতে কৃষ্ণ চরিত্র কলুষিত হয় না। কারণ, তার সাথে কৃষ্ণের পরবর্তীতে আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি।কিন্তু মধ্যযুগের
আবিষ্কার যে যৌবনবতী রাধা, সেটা কিছুতেই ঐতিহাসিক চরিত্র হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কারণ, তা না হলে দ্বারকায় কৃষ্ণের রাজ্য পরিচালনা, মহাভারতের
যুদ্ধ এবং কৃষ্ণের বিবাহিত জীবনে এই রাধার কোনো না কোনো ছাপ বা প্রভাব থাকতো।
কিন্তু তা কি কোথাও আছে ?
কৃষ্ণ কোনো দিন কারো সাথে অন্যায় করে নি এবং কাউকে কোনো দিন কোনো প্রকারে
দুঃখ দেয় নি। খেয়াল করুন, মহাভারতের যুদ্ধের আগে, কৃষ্ণ, যাতে যুদ্ধ না হয়, সেজন্য সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে হস্তিনাপুর রাজসভায় যায় এবং তখন তাকে দুর্যোধন
বন্দি করার চেষ্টা করে। নিরপেক্ষতার স্বার্থে, কুরুক্ষেত্রের
যুদ্ধে সেই দুর্যোধনকেও কৃষ্ণ তার নারায়নী সেনা দিয়ে দিয়েছিলো এবং নিজে অস্ত্রহীন
হয়ে পাণ্ডবদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলো। একবার আঙ্গুল কেটে গেলে, দ্রৌপদী, তারশাড়ির আঁচল ছিঁড়ে কৃষ্ণের আঙ্গুলে বেঁধে দিয়েছিলো, তার বিনিময়ে কৃষ্ণ হস্তিনাপুরের রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চেষ্টার সময়, সেখানে উপস্থিত না থেকেও শত শত হাত শাড়ির মাধ্যমে দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা
করেছিলো। শুধু তাই নয়, পাণ্ডবদের দ্বিতীয় বনবাসের সময়, ভাতের
হাঁড়িতে পড়ে থাকা শুধু মাত্র একটি ভাত খেয়ে কৃষ্ণ অলৌকিকভাবে, খেতে বসা উপস্থিত সকল সাধু-সন্ন্যাসীদের পেট ভরিয়ে তাদেরকে সন্তুষ্ট চিত্তে
বিদায় করতে দ্রৌপদী ও যুধিষ্ঠিরকে সাহায্য করেছিলো।
শ্রদ্ধা ভক্তি নিয়ে স্মরণ করলে যে কৃষ্ণ, তার ভক্তের
প্রতি এমনভাবে সাড়া দেয়, সেই কৃষ্ণকে, চৈতন্যদেব প্রভাবিত বৈষ্ণব পদাবলীর রাধা, এত ডেকেও
কেনো তার সাড়া পায় না ? এখানে বলে রাখি, বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধার সাথে কৃষ্ণের কোনো মিলন নেই, এখানে রাধার শুধুই বিরহ আর কৃষ্ণকে পাওয়ার ব্যাকুলতা।
এসব বিষয় বিবেচনা করলে, এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমানিত হয়
যে, কৃষ্ণের সাথে যৌবনবতী রাধা, কবিদের
উপলব্ধির ভুল আর শুধুই কষ্ট কল্পনা। বাস্তবে বৃন্দাবনে কৃষ্ণের বাল্যকালে কোনো
রাধা থেকে থাকলেও, তার সাথে যুবক কৃষ্ণের কোনো সম্পর্ক নেই এবং এজন্যই রাধা কৃষ্ণের প্রেম, কোনো প্রকারেই ঐতিহাসিক নয়, সম্পূর্ণ
কাল্পনিক।
জয় শ্রী কৃষ্ণ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন