হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলোতে ‘হিন্দু’ শব্দের
উল্লেখ নেই কেনো ?
( বা সিন্ধু শব্দ থেকে হিন্দু শব্দের উৎপত্তি হওয়ায়, হিন্দুদের কি এতে কোনো দায় বা দোষ আছে ?)
উপরের এই প্রশ্নসহ হিন্দুধর্ম সম্পর্কে আরো কিছু প্রশ্ন আমাকে করেছে Debdulal Sahana নামের এক ব্যক্তি। আমার এক পোস্টের কমেন্টে করা তার প্রশ্নগুলো আগে দেখে নিন, তারপর দেখবেন আমার উত্তর।
“আপনার কাছে আমার কয়েকটা প্রশ্ন, তার আগে বলে রাখি আমি জন্মসূত্রে হিন্দু (শুদ্র) আর কোন ভাবেই আমি মুসলমান দ্বারা প্রভাবিত নই । প্রশ্ন হল
(1) একই ধর্মের মধ্যে থেকেও কি করে এক শ্রেণির
মানুষ ( ব্রাহ্মণ) বাকী অন্য তিন শ্রেণীর উপরে হয় ?
(2)শুধু জন্মগত ভাবে যদি ব্রাহ্মণ না হওয়া যেত তবে ব্রাহ্মণের অশিক্ষিত, মূর্খ, গোঁয়ার ছেলেকে পূজা পাঠের অধিকার কে দেয় ?
(3) আপনি কি পরজন্মে বিশ্বাসী ?
(4) আমাদের এই হিন্দু ধর্মের মধ্যে যে কয়েক হাজার জাতি আছে সেখানেও ব্রাহ্মণ সবার উপরে । তাহলে একটা জিনিস লক্ষ্য করুন বর্ণ এবং জাতি দুই ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ সবার উপরে । তাহলে এই বর্ণ আর জাতি ব্যবস্থা কারা সৃস্টি করেছে ?
অনেক প্রশ্ন থাকলেও এটাই শেষ
(5) হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা কে , হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের নাম কি ,আর বর্তমান হিন্দুদের যে সকল ধর্মগ্রন্থগুলি খ্রীষ্টপূর্ব 1920 আগে ছাপানো হয়েছিল সেগুলির কোথাও হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই কেন ?”
Like • Reply • 2 • 16 hrs • Edited
প্রশ্নের উত্তর মানুষকে সন্তুষ্টি প্রদান করে। নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সকল প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলে মানুষ আত্মতৃপ্তি পায়, এর ফলে মানুষ অন্যের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয় না, ফলে আপন ধর্ম-সংস্কৃতি রক্ষা পায়। এজন্য প্রতিটি হিন্দুর হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর জানা খুবই জরুরী। যিনি আমাকে এই প্রশ্নগুলো করেছে, তাকে আমি অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই কারণে যে, তার জানার আগ্রহ আছে এবং প্রশ্নগুলো আমাকে করে তিনি আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমার লেখা পড়ে হয়তো তার এটা মনে হয়েছে, তার মনের ক্ষুধা আমিই মেটাতে পারবো, যেটা আমার কাছে অশেষ সম্মানের। এরকম প্রশ্ন অনেকেই করে, আমি আমার সাধ্যমতো সেগুলোর উত্তর দিই, যে কাজগুলো করার কথা ছিলো আমাদের ধর্মগুরুদের, আপনাদের চাওয়ার কারণে সেটা আমি করতে পারছি, এটাও আমার কাছে বিশেষ সম্মানের। যা হোক, তার প্রথম প্রশ্ন হলো,
(1) একই ধর্মের মধ্যে থেকেও কি করে এক শ্রেণির মানুষ ( ব্রাহ্মণ) বাকী অন্য তিন শ্রেণীর উপরে হয় ?
গীতার ৪/১৩ শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “চাতুর্বণ্যং
ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ”
অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই গুণ ও কর্ম অনুসারে সমাজে চারটি শ্রেণী
সৃষ্টি করেছেন। এই শ্রেণী বিভাগ হলো সমাজের বাস্তবতা। কারণ সমাজে সবাই সমান হলে
সমাজ চলতো না। একটা সমাজে যেমন ডাক্তার-শিক্ষক দরকার, তেমনি
মুচি-মেথরেরও দরকার। এখানে সবাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডাক্তার-শিক্ষক ছাড়া যেমন সমাজ
চলবে না, তেমনি মুচি-মেথর ছাড়াও সমাজ চলতে পারবে
না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমাজে ব্রাহ্মণরা কিভাবে শ্রেষ্ঠ হয়ে
উঠলো ?
একই পিতার চার পুত্রের মধ্যে কোনো একজন যদি পড়াশুনা করে জ্ঞানে-গুণে বড় হয়ে ওঠে, তাহলে অন্য তিন ভাইয়ের মর্যাদা কি তার সমান হবে ? এই জ্ঞানী-গুণী ভাই যেসব জায়গায় যেতে পারবে, যেসব লোকজনের সাথে উঠা-বসা করতে পারবে, অন্য তিন ভাই কি তা করতে পারবে ? উত্তর হচ্ছে, না। আসলে এভাবেই হিন্দু সভ্যতার শুরুতেই কিছু লোক পড়াশুনার মাধ্যমে শাস্ত্রজ্ঞান অর্জন করে অন্যদের চেয়ে নিজেদেরকে বড় করে তুলেছিলো। আর যারা নিজেদেরকে বড় করে তুলতে পেরেছিলো, তারাই জন্মসূত্রে আজকের ব্রাহ্মণ। জ্ঞানে-গুণে নিজেদেরকে বড় করে তুলে এই লোকগুলো পৌঁছে গিয়েছিলো শাসকদের কাছাকাছি; কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যও যে বিদ্যাবুদ্ধির দরকার তারও যোগানদাতা ছিলো এরা; উদাহরণ হিসেবে ‘চাণক্য পণ্ডিত’কে স্মরণ করতে পারেন। সব মিলিয়ে এই শ্রেণীর লোকজন পৌঁছে গিয়েছিলো সমাজের শীর্ষে, এমন কি যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতো, সেই ক্ষত্রিয়দেরও উপর । এভাবেই ব্রাহ্মণ শ্রেণী পৌঁছে গিয়েছে হিন্দুসমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থানে। মূলত এটা কর্মের ফল, যে কর্ম দেহের নয়, মস্তিষ্ক্যের। আর এটা তো চিরন্তন সত্য যে যারা মাথা খাটায়, সমাজে তাদের মূল্য বেশি। একারণেই ইঞ্জিনিয়াররা এসি রুমের মধ্যে বসে থেকে মাসে আয় করে লাখ লাখ টাকা আর সেই ইঞ্জিনিয়ারের প্ল্যান যারা দৈহিক পরিশ্রম ক’রে বাস্তবায়ন করে তারা মাসে পায় কয়েক হাজার টাকা। এছাড়াও একটু হিসেব করে দেখবেন, প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ পর্যন্ত যারাই বিজ্ঞান, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতিষ এর মতো ক্ষেত্রগুলোতে কিছু না কিছু অবদান রাখতে পেরেছে, তারা সবাই ব্রাহ্মণ শ্রেণী থেকে উঠে আসা। মূলত এই জ্ঞানের চর্চার কারণেই ব্রাহ্মণরা হিন্দু সমাজে শ্রেষ্ঠ বর্ণের আসন লাভ করতে পেরেছিলো।
তার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো,
(2) শুধু জন্মগত ভাবে যদি ব্রাহ্মণ না হওয়া যেত তবে ব্রাহ্মণের অশিক্ষিত, মূর্খ, গোঁয়ার ছেলেকে পূজা পাঠের অধিকার কে দেয় ?
“চাতুর্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাশঃ” গীতার এই শ্লোক থেকে স্পষ্ট যে জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শুদ্র নয়; এই বিভাজন- কর্ম ও গুণ অনুসারে। কিন্তু শুধুমাত্র ব্রাহ্মনের ঘরে জন্মানোর বদৌলতে কোনো গুণ না থাকার পরেও একজন ব্রাহ্মণপুত্র কিভাবে পূজা-পাঠের অধিকার পাচ্ছে ? এর প্র্থম কারণ সিস্টেম, দ্বিতীয় কারণ সামাজিক মনোভাব। সিস্টেমটা হলো রাজার ছেলে খুব সহজেই রাজা হতে পারে এবং তার গুণ ও যোগ্যতা কিছুটা কম থাকলেও রাজকার্য খুব সহজে ম্যানেজও করতে পারে; কারণ জন্ম থেকেই সে ঐ সিস্টেমের মধ্যেই বড় হয়েছে। এক্ষেত্রে একজন সাধারণ লোক, তার যতই গুণ ও যোগ্যতা থাকুক না কেনো হঠাৎ করে রাজা হলে সবদিক সামলাতে পারবে না, কিছুদিন তাকে ঐ সিস্টেমের মধ্যে থাকতে হবেই । ব্রাহ্মণের অযোগ্য ছেলে যে পূজা-পাঠের অধিকার পাচ্ছে, তার কারণ এই সিস্টেম। এই সিস্টেম এরই দ্বিতীয় স্টেপ হচ্ছে সামাজিক মনোভাব। রাজার অযোগ্য ছেলে রাজা হলেও যেমন সাধারণ প্রজাদের যেমন খুব বেশি আপত্তি থাকে না, তেমনি ব্রাহ্মণের অযোগ্য ছেলে পূজা করলেও সমাজের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, ও তো ব্রাহ্মণেরই ছেলে, কিছু না কিছু তো ও জানেই, ওর তুলনায় আমরা তো কিছুই জানি না। মূলত সামাজিক এই মনোভাবের কারণেই গুণের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও পূজা-পাঠের অগ্রাধিকার পাচ্ছে জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণরা।
এখন এই বিষয়টিকে মুসলিম সমাজের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করুন। হঠাৎ করেই একজন মুসলমান কিন্তু মসজিদে ইমামতি করার সুযোগ পায় না। মসজিদে ইমামতি করার সুযোগ পায় সাধারণত মাদ্রাসার ছাত্ররা এবং এই ছাত্রদের কমপক্ষে ১২ বছর মাদ্রাসায় পড়ে ইমাম হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় এবং তারপর তাকে মুসলিম সমাজ ইমাম বলে স্বীকার করে নেয়। এখন আপনিই চিন্তা করুন, জন্ম থেকেই কোনো হিন্দু যদি পূজা-পাঠের সিস্টেমের মধ্যে বড় না হয় এবং সে সম্পর্কে তার যদি কিছু জ্ঞান না থাকে, তাহলে তাকে হিন্দু সমাজ- গুরু বা পুরোহিত হিসেবে মেনে নেবে কেনো ? জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ না হলেও, ১০/১২ বছর আপনি যদি হিন্দু শাস্ত্র নিয়ে অধ্যয়ন করেন এবং এই প্রসেস নিয়ে থাকেন তাহলে কিন্তু হিন্দু সমাজ আপনাকে গুরু বা পুরোহিত হিসেবে নিশ্চয় মেনে নেবে। কারণ, তখন সাধারণ হিন্দুদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মাবে যে, না আপনি পারেন এবং আপনার মধ্যে
সেই গুণ বা যোগ্যতা অর্জিত হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ এবং স্বামী প্রণবানন্দ
জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ নন, কিন্তু ব্রাহ্মণ হয়ে উঠতে তাদের কত বছর
লেগেছিলো ?
গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন, “তুমি ব্রাহ্মণ হয়ে ওঠো।” কিন্তু অর্জুন তো ক্ষত্রিয়। এর মানেও হলো, যে কূলেই জন্ম হোক না কেনো, ব্রাহ্মণ হওয়া যায়। আর ব্রাহ্মণ যদি হওয়া যায় বা ব্রাহ্মণ্যত্ব যদি অর্জন করা যায়, তাহলে সেই ব্যক্তি পূজা করতে পারবে না কেনো ?
সুতরাং শাস্ত্র মতেই যে কোনো হিন্দুই ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন করার পর ব্রাহ্মণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে পূজা-পাঠ করতে পারে। কিন্তু এসব তথ্য জানার পরও হিন্দুরা পূজা করার সময় সেই ব্রাহ্মণেরই শরণাপন্ন হয় কেনো ? এখানেই আসে অভিজ্ঞতার কথা, প্রশ্ন আসে যোগ্যতার। আপনি জন্মসূত্রে রাজমিস্ত্রী নন এবং সেই কাজ কখনো শিখেনও নি। তাহলে ইটের বাড়ি বানানোর সময় আপনি রাজমিস্ত্রীকে ডাকবেন, না নিজেই বাড়ি বানাবেন ?
উনার তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, আপনি কি পরজন্মে বিশ্বাসী ?
এটা একান্তই ব্যক্তিগত প্রশ্ন। জানি না আপনি কেনো এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন ? তারপরও বলছি, হ্যাঁ, আমি জন্মান্তরে বিশ্বাসী।
উনার ৪র্থ প্রশ্ন,
(4) আমাদের এই হিন্দু ধর্মের মধ্যে যে কয়েক হাজার জাতি আছে সেখানেও ব্রাহ্মণ সবার উপরে । তাহলে একটা জিনিস লক্ষ্য করুন বর্ণ এবং জাতি দুই ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ সবার উপরে । তাহলে এই বর্ণ আর জাতি ব্যবস্থা কারা সৃস্টি করেছে ?
ব্রাহ্মণ সম্পর্কে ১ নং প্রশ্নের উত্তরে সবকিছু আলোচনা করেছি। ব্রাহ্মণরা যে কেনো সবার উপরে, আশা করি সেই আলোচনা থেকেই তা বুঝতে পেরেছেন। আপনার এই
প্রশ্নের শেষ অংশ হলো,
“তাহলে এই বর্ণ আর জাতি ব্যবস্থা কারা সৃস্টি করেছে ?”
এই বর্ণ বা জাতি ব্যবস্থা কেউ সৃষ্টি করে নি। প্রাকৃতিকভাবেই সামাজিক নিয়ম অনুসারে এই বর্ণ বা জাতি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। প্রাচীন কালে মানুষ যখন সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে শুরু করে তখন গুণ ও যোগ্যতা অনুসারে যে যার কাজ বেছে নেয় অথবা বলা যায় যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মলাভ করে আর এই কর্ম অনুযায়ী ই সমাজে স্থান পায় বর্ণ বা জাতি ব্যবস্থা। ঘোষ, নাপিত এবং মেথর একসময় শুধু হিন্দু সমাজেরই পদবী বা অংশ ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু মুসলমান জীবিকার তাগিদে হিন্দু সমাজের এই পেশাগুলোতে নিজেরাই ইচ্ছা করেই ঢুকে গেছে, এখন তাদেরকে কেউ মুসলমান ঘোষ, মুসলমান নাপিত বা মুসলমান মেথর বলে ডাকে না। এখন তারা ঘোষ, নাপিত বা মেথর বলেই পরিচিত। এই পরিচিতি তাদেরকে কেউ দেয় নি, তারা নিজেরাই বেছে নিয়েছে। সেইরকম প্রাচীনকালে যার যার পেশা বা কর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বর্ণ বা জাতি ব্যবস্থা, কেউ কাউকে কিছু চাপিয়ে দেয় নি। একই বর্ণ বা শ্রেনীর মধ্যে হলেও হিন্দুদের নামের শেষে বিভিন্নরকম পদবী বা টাইটেল দেখা যায়, এটা কাউকে ছোট বা বড় করার জন্য নয়, প্রত্যেক বংশ বা গোষ্ঠীকে আলাদা আলাদা ক’রে চেনার জন্য।
উনার শেষ প্রশ্ন,
(5) হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা কে, হিন্দুদের
ধর্মগ্রন্থের নাম কি ,আর বর্তমান হিন্দুদের যে সকল
ধর্মগ্রন্থগুলি খ্রীষ্টপূর্ব 1920 আগে ছাপানো হয়েছিল সেগুলির কোথাও হিন্দু
শব্দের উল্লেখ নেই কেন ?
ধর্মের কোনো প্রবক্তা থাকে না, প্রবক্তা থাকে মত বা পথের। যেমন- কার্লমাক্স প্রবর্তন করে গেছে marxism, এই মার্ক্সিজম (মার্কস+ইজম,) এরই আরেক নাম কমিউনিজম খেয়াল করুন শব্দগুলোর সাথে আছে ‘ইজম’। ইংরেজি শব্দ ‘ইজম’ এর অর্থ হলো মত বা পথ। কোনো ব্যক্তি যখন কোনো মত প্রকাশ করে তখন তাকে বলে ইজম। সেই অর্থে হিন্দুধর্মকে বোঝাতে হিন্দু শব্দের সাথে ‘ইজম’ কখনোই ব্যবহার হবে না। কারণ, হিন্দুধর্ম কোনো একক ব্যক্তির চিন্তা-চেতনার ফসল নয়। একমাত্র হিন্দুধর্ম ছাড়া পৃথিবীর সকল Religious মত, যাদেরকে বলা হচ্ছে ধর্ম, সেগুলো কখনোই ধর্ম নয়; কারণ, মানুষ কখনো ধর্মের প্রবর্তন করতে পারে না। ধর্মের সৃষ্টিকর্তা প্রকৃতি নামের ঈশ্বর।
অনেকেই জানেন যে, ইসলাম ধর্মের বয়স ১৪০০ বছর, খ্রিষ্টানধর্মের বয়স ২ হাজার বছর, বৌদ্ধধর্মের বয়স আড়াই হাজার বছর, ইহুদি ধর্মের বয়স ৩ হাজার বছর, কিন্তু পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির বয়স কি এই ২ বা ৩ হাজার বছর ? বিজ্ঞান বলছে বিবর্তনের মাধ্যমে পৃথিবীতে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছে প্রায় ২০ লাখ বছর আগে। কিন্তু মানুষ নিজস্ব জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা সভ্যতা সৃষ্টি করতে পেরেছে মাত্র হাজার দশেক বছর আগে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ বেদ এর আবির্ভাব সময়ও ৮/১০ হাজার বছর। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি বেদ এর রচনাকাল বলতে যেটা বোঝায়, সেটা মন্ত্র বা শ্লোকগুলোকে লিপিবদ্ধ করার কাল, ওগুলো আবির্ভাবের কাল নয়। লিখিত রূপ পাওয়ারও বহুপূর্ব থেকে বেদ এর মন্ত্রগুলো গুরু শিষ্য পরম্পরায় শ্রুত হয়ে আসছে অর্থাৎ একজনের কাছ থেকে আরেকজন শুনে মুখস্থ করে আসছে।
পৃথিবীর সব কিছুই প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটে, তাই মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে মানুষ যে ধর্ম পালন করতে শুরু করেছে, তাই মানবধর্ম। আর মানবধর্মেরই আরেক নাম সনাতন ধর্ম এবং সনাতন ধর্মের উপরই যে মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে সেই কথাও বলে গেছেন বেদের মুনি ঋষিরা, দেখুন নিচে-
" সনাতন মানবধর্মমূলং হি প্রকৃতি।”
এর অর্থ- মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সনাতন ধর্ম নিয়েই জন্মগ্রহণ করে।
এই কথাটি যে কত বা সত্য তার প্রমান পাবেন ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম পুরুষদের খতনা করার বিষয়টি বিবেচনা করলে। এই সব ধর্ম যদি সত্য হয়, তাহলে ঐ সব ধর্মের পুরুষরা খতনাসহ জন্ম নেয় না কেনো ? কেনো তাদেরকে নতুন করে খতনা করাতে হয় ? খতনা বিহীন কোনো পুরুষের জন্ম মানেই তার সনাতন ধর্মে জন্ম এবং সে হিন্দু। এছাড়াও ইসলামে সকল প্রকার শিল্পের চর্চা নিষেধ হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু মুসলিম পরিবারগুলোতে শিল্পপ্রতিভা নিয়ে শিশুরা্ জন্ম নেয় বা নিয়েছে, এটাও প্রমান করে যে ইসলাম মিথ্যা এবং সকল শিশুই সনাতন ধর্মের উপর, সনাতন ধর্মের বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এভাবে মানব ধর্ম হচ্ছে সনাতন ধর্ম, যার পরিবর্তিত নাম হচ্ছে হিন্দুধর্ম। সনাতন মানবধর্ম হচ্ছে প্রকৃতিসৃষ্ট ধর্ম, তাই এই ধর্মের কোনো প্রবর্তক নেই। কিছু বিপথগামী মানুষ নিজেরা কিছু অবাস্তব মত সৃষ্টি করে তাকে পৃথিবীতে ধর্ম বলে চালিয়ে প্রকৃতির সন্তান মানুষকে ধোকা দিয়ে আসছে; তাদের আল্লা বা গড যদি সত্যিই থেকে থাকে তাহলে তারা ৩ হাজার বছর আগে কোথায় ছিলো ? ৩ হাজর বছর আগে যে মানুষগুলো পৃথিবী থেকে মরে গেছে তাদেরকে তারা পথ দেখায় নি কেনো ? ইসলাম তো বলে, যে অমসুলিম অবস্থায় মারা গেছে, সে মুহম্মদের বাপ হলেও বেহেশতে যেতে পারবে না, তাহলে ওই মানুষগুলোর দোষ কী, যারা ইসলাম পৃথিবীতে আসার আগেই মরে গেছে ? দেড় হাজার বছর আগে আল্লা কোথায় ছিলো, কী করছিলো ?
ধর্ম মানে গুণ বা বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে সৃষ্ট প্রতিটা জড় ও জীবের কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেটা প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই ভাবেই প্রকৃতি সৃষ্টি করে দিয়েছে মানুষের ধর্ম- মিথ্যা না বলা, চুরি না করা, পরের সম্পদ লুঠ না করা, বংশ রক্ষা করা এবং বিনা কারণে কাউকে হত্যা না করা, এককথায় নিজে বেঁচে বেড়ে, সৎপথে চলা; এসব, বুদ্ধির সর্বোচ্চ স্তরে উঠা প্রাণী মানুষের জন্য, কারণ মানুষের বিবেক আছে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের জন্য প্রকৃতির ধর্ম হচ্ছে শুধু খেয়ে-দেয়ে টিকে থাকা এবং বংশরক্ষা করা। কিছু মানুষের জন্য কয়েকজন ব্যক্তি নতুন ধর্মমতের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীদের জন্য তাদের দিক নির্দেশনা কী ?
ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে পৃথিবীর সকল মানুষ ও প্রাণীর জন্য একটাই ধর্ম ছিলো, আর সেটা হলো সনাতন। সেজন্য পৃথিবীর সকল প্রাচীন সভ্যতা মূর্তি পূজা করেছে, পৃথিবীর সকল প্রাণী সনাতন ধর্মের বৈশিষ্ট্য নিয়ে সনাতন ধর্মের উপর জন্ম গ্রহণ করেছে এখনও করছে। ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা ইসলাম- কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করে তাদের মতের অনুসারী করতে পেরেছে, কিন্তু পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী অন্যান্য প্রাণীদেরকে কী তারা তাদের ঐসব ধর্মে দীক্ষিত করতে পেরেছে ? কিছু মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো একটি প্রাণীকে কি তারা ইহুদি, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বা মুসলমান বানাতে পেরেছে ? এই সব ব্যক্তিগত মতের ধর্মে আকৃষ্ট হয়ে কিছু মানুষ তাদের প্রাত্যাহিক জীবন যাত্রার ধরণ পাল্টে ফেলেছে, কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর জীবন যাত্রাকে কি তারা পাল্টাতে পেরেছে ? কোনো পাখী কি আযানের শব্দ শুনে মাথা নত করে ? কোনো গরু কি যীশুকে স্মরণ করে বুকে ক্রশ চিহ্ন আঁকে ? একমাত্র হিন্দুরা ছাড়া পৃথিবীর প্রত্যেকটি ব্যক্তিমতের ধর্মের অনুসারীরা মাথায় কোনো না কোনো টুপি পরিধান করে, কিছু নির্বোধ মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণী কি এই প্রথা পালন করে ? বলতে পারেন, মানুষ তো বুদ্ধিমান প্রাণী, অন্যরা তো এত বুদ্ধিমান নয়, এই কথা বলার আগে বাংলায় ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিউগ্রাফী বা এ্যানিমাল প্ল্যানেট এর বিভিন্ন জীবজন্তুর উপর করা কিছু অনুষ্ঠান দেখেন, তখন বুঝতে পারবেন প্রত্যেকটা জীব-জন্তু তাদের নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থায়, তারা কী পরিমান বুদ্ধিমান ?
উনার পরের জিজ্ঞাসা, হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের নাম কি ?
এটা খুব সাধারণ প্রশ্ন হয়ে গেলো। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। তাই এই প্রশ্নের জবাব লিখে পোস্টকে আর বড় করতে চাইছি না।
উনার শেষ প্রশ্ন, আর বর্তমান হিন্দুদের যে সকল ধর্মগ্রন্থগুলি খ্রীষ্টপূর্ব 1920 আগে ছাপানো হয়েছিল সেগুলির কোথাও হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই কেনো ?
উনি এখানে একটা তথ্যগত ভুল করেছেন, খ্রিষ্টপূর্ব ১৯২০ মানে হলো বর্তমান থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগের কথা। সেই সময় কোনো ছাপাখানা ছিলো না, তাই ছাপার কোনো প্রশ্নই আসে না। ১২২১ সাল থেকে চীনে বই ছাপার চেষ্টা বিভিন্নভাবে করা হলে মোটামুটি আধুনিক ছাপাখানা তৈরি করেন গুটেনবার্গ নামে এক বিজ্ঞানী ১৪৫৫ সালে জার্মানিতে। এই ছাপাখানা ভারতে নিয়ে আসে ইংরেজরা এবং ১৮০০-১৮৩০ এর মধ্যে কোনো এক সময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের স্টুডেন্টদের জন্য অন্যান্য বাংলা পুস্তকের পাশাপাশি তারা প্রথম বাংলায় বাইবেল প্রিন্ট করে এবং তারপর করে বেদ এর প্রিন্ট। বরং এখানে প্রশ্ন হতে পারে হিন্দু ধর্মের কোনো গ্রন্থে হিন্দু শব্দের উল্লেখ নেই কেনো ?
৮ হাজার বছর পূর্বে সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে বর্তমান পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় একটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো, লেটেস্ট গবেষনা বলছে, এই মহেঞ্জোদারো-হরপ্পাই ছিলো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। এই সিন্ধু নদের তীরেই উচ্চারিত হয়েছিলো প্রথ বেদমন্ত্র। পরবর্তীতে পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যখন অন্যান্য সভ্যতাগুলো গড়ে উঠলো এবং তারা যখন সিন্ধুসভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারলো, তখন সিন্ধুকে উচ্চারণ করতে না পেরে বললো হিন্দু। এটা কাদের প্রব্লেম, সিন্ধু সভ্যতার লোকজনের, না যারা ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে না পেরে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করলো, তাদের ? এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বিকৃত উচ্চারণ কিভাবে সিন্ধুসভ্যতার লোকজনের উপর চেপে বসলো ?
সিন্ধু সভ্যতার জ্ঞান, ঐশ্বর্য এবং ধনসম্পদ শুরু থেকেই পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সিন্ধুকে যেমন বিদেশিরা উচ্চারণ করতো হিন্দু, তেমনি নিজেদের মধ্যে অলোচনায় সিন্ধু সভ্যতার লোকজনের দেশকে বোঝাতে তারা বলতো হিন্দুস্থান এবং শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতো আরবের লোকজন। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশকে বোঝাতে তারা ‘আল হিন্দ’ শব্দটিও ব্যবহার করতো। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের ভাষা যেহেতু ছিলো হিন্দি, সেহেতু ‘আল হিন্দ’ বলার পেছনে হয়তো সেই বিষয়টিও কাজ করতো, এমনকি মুহম্মদও তার এক হাদিসে এই অঞ্চলকে হিন্দ বলে উল্লেখ করেছে। হাদিসটি এরকম:
আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, “আল্লার রাসূল আমাদেরকে হিন্দ (উপমহাদেশ) বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যদি আমি এতে অংশগ্রেহণ করতে সক্ষম হই তবে আমা্র জান ও মাল দুটোই এতে ব্যয় করবো। যদি আমি নিহত হই, আমি সর্বশ্রেষ্ঠ শহীদের অন্যতম হবো। আর আমি যদি ফিরে আসি আমি হবো আবু হুরায়রা যে কিনা জাহান্নাম থেকে মুক্ত।”
মুহম্মদের এই মনোভাবের জন্যই ৬৫০ সাল থেকে আরবের খলিফারা একের পর এক অভিযান চালিয়ে ভারতকে দখল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হয় মুহম্মদ বিন কাশিম ৭১২ সালে, খেয়াল করুন আক্রমনটা ছিলো ঠিক সেই সিন্ধুতে, যদিও তখন সেই প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা আর ছিলো না। এরপর আস্তে আস্তে ভারতের লোকজনের উপর চেপে বসে এ্যারাবিক শাসন, যারা ভারতকে হিন্দুস্থান বলতেই বেশি পছন্দ করতো, এর মানে হচ্ছে এটা হিন্দুদের দেশ বা স্থান। এভাবে মুখে মুখে বলে এলেও প্রশাসনিকভাবে দিল্লির রাজ দরবারে কাগজে কলমে হিন্দুস্থান শব্দের প্রয়োগ ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, এরপর মোগল শাসকেরা এই দেশকে হিন্দুস্থান এবং এর স্থানীয় অধিবাসীদেরকে তো হিন্দু ছাড়া অন্য কোনো শব্দে উচ্চারণই করতো না। এভাবে হাজার বছরের এ্যারাবিক-ইসলামিক শাসনে ভারত হয়ে উঠেছে হিন্দুস্থান আর তার অধিবাসী আর্যরা, সনাতনীরা হয়ে উঠেছে হিন্দু। এখন আপনিই বলুন কয়েক হাজার বছরের পুরোনো বেদ, মহাভারত, রামায়ণসহ অন্যান্য হিন্দুধর্মীয় পুস্তকে হিন্দু শব্দটি আসবে কোথা থেকে ?
আশা করি সকল প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন।
জয় হিন্দ।
জয় শ্রীরাম। জয় শ্রী কৃষ্ণ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন